সকলেই মনে করতেন তিনি অর্ধেক উট অর্ধেক মানবী। আর সেটাই হয়ে উঠেছিল সার্কাস জীবনে তাঁর ইউএসপি। তবু সেই জীবন থেকে তড়িঘড়িই ইতি টেনেছিলেন ক্যামেল গার্ল এলা। সার্কাস-জীবনের বাইরে কেমন ছিল তাঁর জীবনখানা? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
জন্মলগ্ন থেকেই তিনি আর পাঁচজনের থেকে আলাদা। সাধারণ মানুষ যেভাবে হাঁটে-চলে, ঘোরে, তেমনটা তাঁর ক্ষেত্রে হয়নি। ছোট থেকেই তাঁর পা দুটো উল্টো। অনেকটা উটের মতো যেন। চিকিৎসকেরা জানান, কনজেনিটাল জেনু রিকারভেটাম নামক এক বিরল রোগের শিকার মেয়েটি। সাধারণ ভাবে হাঁটু পায়ের ঠিক যে দিকে থাকে, টেনিসির বাসিন্দা এলা হার্পারের হাঁটুটি ছিল ঠিক তাঁর বিপরীত দিকে। গরিব কৃষক পরিবারের মেয়ে এলা। সময়টা ১৮৭০ সাল। ফলে না ছিল তেমন চিকিৎসার সুযোগ, না পরিবারের ছিল তেমন সঙ্গতি। এলার দুটি যমজ ভাই ছিল। জন্মের তিন মাসের মাথায় মারা যায় তাদের একজন। এলা ছাড়াও আরও তিন সন্তান ছিল উইলিয়াম হার্পার ও মিনার্ভা অ্যানের।
আরও শুনুন: দ্রৌপদী নাম হয়েছিল স্কুলে, নিজের ‘আসল’ নাম জানালেন দেশের নয়া রাষ্ট্রপতি
বিশেষ ভাবে সক্ষম বলে কথাটার চল হয়নি সেসময়। বরং যারা আলাদা, সাধারণের চেয়ে একটু অন্যরকম, তাঁদের জায়গা হত সোজা সার্কাসে। এলার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। মাত্র বারো বছর বয়সে সার্কাসে যোগ দিলেন এলা। সেন্ট লুইস থেকে শুরু করে নিউ অরল্যানস, বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে সার্কাসপার্টির সঙ্গে খেলা দেখিয়ে বেড়াতেন এলা। জমে উঠত সার্কাসের শো।
না, এলা হার্পার নয়, সেখানে তিনি ছিলেন ‘ক্যামেল গার্ল’। এককথায় উটমানবী বললেও ভুল হয় না। আস্তে আস্তে সয়ে গেল সব। নানা দেশে নানা রাজ্যে সার্কাস পার্টির সঙ্গে ঘুরে ঘুরে খেলা দেখাতে লাগলেন এলা। ক্রমে জনপ্রিয়তা বাড়তে লাগল তাঁর। সে সময় ডব্লিউ এইচ হ্যারিস নামে এক ব্যাক্তির নজরে পড়লেন এলা। ১৮৮৬ সাল নাগাদ তাঁর নিকেল প্লেট সার্কাসে গিয়ে ভিড়লেন এলা। একটি উটের সঙ্গে মঞ্চে খেলা দেখাতেন ক্যামেল গার্ল। দর্শকদের জন্য সুবিধা হত তুলনা খোঁজাটা। অর্ধেক উট অর্ধেক মানুষ, এলার পরিচয় ছিল অনেকটা তেমনই। ধীরে ধীরে পোস্টারেও দেখা যেতে লাগত এলাকে। এমনকি প্রত্যেকটি শো-র আগে তাঁর উটমানবী হয়ে ওঠার কারণ ও বিবরণ লেখা কার্ড বিতরণ করা হত দর্শকমহলে। আশ্চর্য এলাকে দেখতে উপচে পড়ত দর্শকদের ভিড়।
আরও শুনুন: শাহজাহান একা নন, ‘তাজমহল’ বানিয়েছিলেন আরও অনেকেই! কোথায় কোথায় রয়েছে সেগুলি?
তবে এত জনপ্রিয়তার পরেও শুধুমাত্র সার্কাসের চৌহদ্দিতে আটকা পড়ে থাকতে চাননি এলা। সার্কাস থেকে রোজগার মন্দ হত না এলার। সপ্তাহ প্রতি প্রায় ২০০ ডলার করে পেতেন তিনি। সে সময়ের সাপেক্ষে বলাই বাহুল্য কম নয় অর্থটা। বেশ কিছুটা অর্থ জমিয়ে নেওয়ার পর ১৬ বছর বয়সে সার্কাসের জীবনে ইতি টানলেন এলা। বরং শুরু করলেন পড়াশোনা। সমস্ত খ্যাতি, পরিচিতি ছেড়ে সার্কাসের ময়দান ছেড়ে হঠাৎই গায়েব হয়ে গেল ক্যামেল গার্ল।
১৯০০ সালের আদমশুমারি রিপোর্ট বলছে, টেনিসির সুমনের শহরে ফিরে গিয়েছিলেন এলা। ততদিনে তাঁর বাবা গত হয়েছেন একটি দুর্ঘটনায়। ভাইবোনেরাও আর বেঁচে নেই কেউ। আত্মীয় বলতে শুধু মা আর এক ভাইঝি। সেখানে থাকতে থাকতেই প্রেমে পড়েন রবার্ট সেভলি বলে এক ব্যক্তির। তিনি ছিলেন স্কুলশিক্ষক, পাশাপাশি একটি ছবির দোকানের হিসেবও দেখতেন রবার্ট। ১৯০৫ সাল নাগাদ রবার্টকে বিয়ে করেন এলা। তখন তাঁর বয়স ৩৫।
কিন্তু জীবনটা মোটেই সুখকর হল না এলার। বিয়ের এক বছরের মাথায় মেয়ের জন্ম দিলেন তাঁরা। মাত্র ৬ মাসের মাথায় মারা গেল সেই সন্তান। সেই শোকের সঙ্গে যুঝতে সুমনের ছেড়ে ডেভিডসন এলাকায় উঠে এলেন তাঁরা। এলার মাকেও নিয়ে এলেন তাঁদের সঙ্গেই। মানসিক ভাবে একটু ধাতস্থ হওয়ার পরে আরও একটি সন্তানের কথা ভাবলেন এলা ও রবার্ট। এবার আর জন্ম দেওয়ার ঝুঁকি নিলেন না এলা। বরং একটি কন্যাসন্তান দত্তক নেওয়ার কথা ভাবলেন দম্পতি। নিলেনও। কিন্তু না, সন্তানসুখ লেখা নেই তাঁদের ভাগ্যে। তিন মাসের মৃত্যু হল সেই সন্তানেরও।
আবার শহর ছাড়লেন এলা। এবার তাঁরা উঠে এলেন টেনিসির ন্যাশভিল শহরে। সেটা ১৯২০ সালের কথা। ১৯২১ সালে মাত্র ৫১ বছর বয়সে কোলন ক্যানসারে মারা গেলেন ক্যামেল গার্ল। নিজের সন্তানদের পাশেই চিরঘুমে শুয়ে রইলেন এলা। বছর তিনেকের মাথায় মারা যান এলার মা-ও। সার্কাস জীবন থেকে যে অর্থ উপার্জন করেছিলেন এলা, তা রবার্টের জন্য ছিল যথেষ্ট। এলার স্মৃতি বুকে নিয়েই বাকি জীবনটা বেঁচে রইলেন রবার্ট। আর এ ভাবেই শেষ হয়ে গেল ক্যামেল গার্লের গল্প। তবে ইতিহাস হয়ে রয়ে গেলেন ক্যামেল গার্ল এলা। যার জীবনটা আক্ষরিক অর্থেই দুনিয়ার কাছে ছিল আশ্চর্য।