মহাভারতের আশ্চর্য নারী দ্রৌপদীর মতোই হার না-মানা এক লড়াইয়ের গল্প যেন হয়ে উঠেছেন তিনি। প্রত্যন্ত গ্রামের এক আদিবাসী পরিবারে জন্ম নেওয়া এই নারী, সেই লড়াইয়ের জোরেই এসে পৌঁছেছেন রাইসিনা হিলসের আলোর বৃত্তে। মহাভারতের দ্রৌপদীর মতোই পুত্রশোক, প্রিয়জনদের হারানোর বেদনাও তাঁকে বিঁধেছে বারবার। অথচ, দ্রৌপদী নাকি তাঁর আসল নামই নয়। সম্প্রতি এমনটাই জানিয়েছেন দেশের নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
স্বয়ং মহাভারতকার বেদব্যাস দ্রৌপদীকে বলেছিলেন, ‘নাথবতী অনাথবৎ’। মহাভারতের এই প্রধান চরিত্রটির সঙ্গে যে দুর্ভাগ্যের কাহিনি জড়িয়ে আছে, সে কথা মনে রেখেই হয়তো তাঁর নামে কোনও শিশুকন্যার নামকরণ করা হয় না সাধারণত। কিন্তু এখানেও ব্যতিক্রম দেশের পঞ্চদশতম রাষ্ট্রপতি, দ্রৌপদী মুর্মু। এই প্রথমবার দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে বসলেন কোনও আদিবাসী মহিলা। পাশাপাশি দেশের সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রপতিও তিনি, যিনি স্বাধীন ভারতেই জন্ম নিয়েছেন। অর্থাৎ একাধিক ক্ষেত্রেই তিনি অনন্যা, যেন মহাভারতের দ্রৌপদীর মতোই। তাঁরই মতো ব্যক্তিগত জীবনে শোকের ঝড় পেরিয়ে এসেছেন তিনি, তবুও জীবনের পথে চলা থামেনি তাঁর। সব মিলিয়ে বারেবারেই মহাভারতের এই আশ্চর্য চরিত্রটির সঙ্গে তাঁর তুলনা টানা হয়েছে।
আরও শুনুন: হারিয়েছেন স্বামীকে, অকালমৃত্যু দুই সন্তানের… শোকের ঝড় পেরিয়ে রাইসিনা হিলসে দ্রৌপদী মুর্মু
কিন্তু সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে দ্রৌপদী মুর্মু জানিয়েছেন, দ্রৌপদী আদৌ তাঁর আসল নাম নয়। আসলে এই নামটি জন্মসূত্রে তিনি পাননি। এক ওড়িয়া পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটিতে দ্রৌপদী মুর্মু বলেন, তাঁর সাঁওতালি নাম ছিল পুঁটি। আসলে সাঁওতালি সমাজে কোনও মেয়ের নাম হয় তার পিতামহীর নামে। কিন্তু স্কুলে পড়ার সময় ওড়িশারই অন্য জেলা থেকে আসা এক শিক্ষিকা তাঁর নামটি বদলে দেন। যদিও তাঁর আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা অনেকেই সেই নাম ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারতেন না। কিন্তু সেই শিক্ষিকা যে সযত্নে সেদিনের কিশোরী মেয়েটির নিজস্ব পরিচয় তৈরি করে দিয়েছিলেন, তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভোলেননি দ্রৌপদী মুর্মু।
আরও শুনুন: মেয়ের নাম দ্রৌপদী রাখেন না অভিভাবকরা! রাষ্ট্রপতি কি বদলে দেবেন ধারণা?
বাবাসাহেব আম্বেদকর দেশের এই পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর উন্নতির কথা না ভাবলে জঙ্গলে কাঠ কাটা, কিংবা রাস্তা তৈরি করার ‘কামিন’ হিসেবে শহরে আসাই নিয়তি হত তাঁর। কয়েক বছর আগে কলকাতায় এসে এমন কথাই বলেছিলেন তখনকার ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল দ্রৌপদী মুর্মু। আর এদিন দেশের পঞ্চদশতম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়ে দ্রৌপদী বলেন, এ ঘটনা আসলে দেশের প্রতিটি দরিদ্র মানুষের প্রাপ্তি। বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তাঁর এই উত্থান আসলে প্রমাণ করে যে, ভারতের দরিদ্র মানুষেরা শুধু স্বপ্নই দেখেন না, সেই স্বপ্ন পূরণও করতে পারেন। দেশের দরিদ্র মানুষ, বিশেষ করে কোটি কোটি নারীর স্বপ্ন আর তাঁদের যোগ্যতার প্রতীক তাঁর এই উত্থান। তিনি মনে করেন, ভারতের গণতন্ত্রের শক্তি এখানেই যে, এ দেশে দরিদ্র আদিবাসী পরিবারে জন্মানো কোনও মেয়েও একদিন দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে নির্বাচিত হতে পারে। গরিব, দলিত, উপজাতি সম্প্রদায়- সকলের উন্নয়নের জন্য যে মানুষেরা দিনের পর দিন কাজ করে চলেছেন, তাঁরা তাঁদের ছায়া দেখতে পাবেন দ্রৌপদীর মধ্যে, এমনটাই বিশ্বাস তাঁর।