এ যেন, অতীতে চোখ রেখে ভবিষ্যতের দিকে এগোনো। সৃষ্টির প্রায় আদি মুহূর্তটির সন্ধান করছিলেন বিজ্ঞানীরা। আর জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের দরুন তা যখন সম্ভব হল, তখন ভবিষ্যতের দিকেই আরও এক কদম এগিয়ে গেল বিজ্ঞান। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এ এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। আর তার নেপথ্যে থেকে গেল বিজ্ঞানীদের স্বপ্ন, কল্পনা আর অনলস পরিশ্রম। আসুন, শুনে নিই, ঠিক কতটা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে মানুষ পৌঁছাতে পারল সৃষ্টির একেবারে গোড়ায়।
ব্রহ্মাণ্ডের প্রায় আদি মুহূর্তটিকে ধরে ফেলল নাসার ‘জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ’। আর তিনি যেন ফেললেন স্বস্তির নিঃশ্বাস। বললেন, ‘বলে বোঝাতে পারব না, এই কাজ কতটা কঠিন ছিল। অনেকটা সময়ও লাগল। কাজটা কতটা কঠিন আর চ্যালেঞ্জিং যে ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কিন্তু শেষ অব্দি আমরা তা সম্ভব করে তুলতে পেরেছি।’ সারা বিশ্ব যখন নাসা-র অত্যাশ্চর্য টেলিস্কোপের তোলা ব্রহ্মাণ্ডের ছবিতে মশগুল, তখন এভাবেই নিজের তৃপ্তির কথা জানালেন ড. জন ম্যাথর। নাসার এই আকাশচুম্বী পরিকল্পনাকে রূপদানের দায়িত্ব কাঁধে যাঁরা তুলে নিয়েছলেন, তাঁদের মধ্যে একেবারে শীর্ষস্তরে ছিলেন নোবেলজয়ী এই বিজ্ঞানী। এই মিশনে তিনি-ই ছিলেন সিনিয়র প্রজেক্ট সায়েন্টিস্ট।
আরও শুনুন: প্রকৃতির বুকেই আভাস দেশের জাতীয় পতাকার, অপূর্ব দৃশ্যের উল্লেখ ‘অমৃত মহোৎসব’ উদযাপনেও
হাবল স্পেস টেলিস্কোপের সাফল্যের পরে, যখন আরও উন্নত এক টেলিস্কোপের কথা ভাবতে শুরু করলেন বিজ্ঞানীরা, তখনও তাঁরা ভাবেননি, ঠিক কতদিন সময় লাগবে বা কী কী প্রতিকূলতা তাঁদের সামনে আসতে পারে। আসলে তাঁরা একটা স্বপ্ন দেখেছিলেন। আর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সেই স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে। এই স্বপ্নপূরণের মাইলস্টোনে পৌঁছতে কেটে গিয়েছে প্রায় তিনটে দশক। সেই নয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকেই এই প্রজেক্টের কাজ শুরু হয়। এমন একটা টেলিস্কোপ তৈরি করতে চাইছিলেন বিজ্ঞানীরা, যা গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং-কে কাজে লাগিয়ে একেবারে সৃষ্টির আদি মুহূর্তের রহস্যের উপর নজর দিতে পারে। এইরকম ভাবনা থেকেই শুরু হয় এই টেলিস্কোপ তৈরি কাজ। ১৯৯৬ সালে প্রাথমিক পরিকল্পনা ও রূপরেখার কাজ সারা হয়। বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের তিনট দল আলাদা ভাবে গবেষণা করে জানায় যে, এই মিশন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। ১৯৯৭ সালে এ বিষয়ে আরও গবেষণার জন্য ফান্ডিং শুরু করে নাসা। ২০০২ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে টেলিস্কোপটি তৈরির কাজ শুরুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। টেলিস্পোপটির নাম দেওয়া হয় জেমস ওয়েবকে স্মরণ করে। যিনি নাসা-র গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্ব সামলেছিলেন এক কালে। বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে তাঁর অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েই মানুষের সবথেকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী টেলিস্কোপটির নাম তাঁর নামেই রাখা হয়। ২০০৪ থেকে শুরু হয় নির্মাণের কাজ। কিন্তু খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই বিরাট প্রজেক্টের খরচ যা হচ্ছিল, তাতে হিমশিম খাওয়ার জোগাড় নাসা-র। অর্থের ঘাটতি পূরণ করতে নাসা-র হাত হাত রাখে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি এবং কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি। সহজেই অনুমান করা যায়, মানবসভ্যতার জন্য এই মিশন কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
আরও শুনুন: একটি নয়, কোন বার্তা দিতে দেশে স্থাপন করা হয়েছিল বহু অশোক স্তম্ভ?
এখন যখন আমরা এই টেলিস্কোপের সাফল্যে বিস্মিত প্রায়, তখন মনে রাখতে হবে এর নেপথ্যে বিজ্ঞানীদের নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রমের কথা। শোনা যায়, ড. ম্যাথরকে বহুবারই বহু অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তবে বছরের পর বছর তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। জানিয়েছেন, প্রজেক্টের কাজ শেষ না হলে অফিস ছেড়ে নড়ার উপায় নেই তাঁর। কিন্তু শেষ বললেই কি আর শেষ হয়! প্রাথমিক পরিকল্পনা, স্কেচ, গবেষণা ইত্যাদি ধরে টেলিস্কোপটিকে বাস্তব করে তুলতে সময় লেগে গেল ২০ বছরেরও বেশি। এই গোটা পর্বে বিজ্ঞানী ম্যাথর প্রায় দার্শনিক প্রজ্ঞায় পৌঁছেছিলেন। বলেছিলেন, আমরা যত নিখুঁত পরিকল্পনাই করি না কেন, কিছু না কিছু খারাপ ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থেকেই যায়। কিন্তু সেই কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হননি বিজ্ঞানীরা। প্রত্যাশিত ভাবে খরচখরচাও বাড়ছিল, যে কারণে তিনটি সংস্থা একজোট হয়ে কাজ করে। পুরো মিশনে বিজ্ঞানীরা যে কতটা সদর্থক ছিলেন, তা এই খরচের প্রসঙ্গে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির প্রজেক্ট ম্যানেজার পিটার জনসনের একটি কথাতেই স্পষ্ট। হ্যাঁ, বিপুল খরচ হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু জনসন বললেন, ইউরোপের জনসংখ্যা ধরলে মাথাপিছু অধিবাসীদের আর কতই বা খরচ হচ্ছে? প্রত্যেকে যদি ২০ বছর ধরে সস্তার রেস্তোরাঁয় সস্তা এক কাপ করে কফি খায়, তাহলে যা খরচ হবে, তাই-ই দিতে হচ্ছে। একটা মিশনকে সফল করে তুলতে যে মনোভাব ধরে রাখার কথা, দীর্ঘ দুই দশক ধরে তাই-ই লালন করে চলেছিলেন এই প্রজেক্টের জন্য সঙ্গে জড়িত প্রায় সকলে। অবশেষে এসেছিল সাফল্য। গত বছরের ডিসেম্বরে মহাকাশে পাড়ি দিয়েছিল টেলিস্কোপটি। তবে প্রতিকূলতার সেখানেই শেষ নয়। একবার খবর এল, একটা ছোট সাইজের মিটিয়রডের সঙ্গে ঠোকাঠুকি লেগে গেছে টেলিস্কোপের। তবে তেমন বড় ক্ষতি কিছু হয়নি। ২০২২-এর জুলাইতে সার্থকতা পেল বিজ্ঞানীদের এতদিনের পরিশ্রম। ব্রহ্মাণ্ডের এখনও পর্যন্ত আদিতম মুহূর্তের সাক্ষী থাকল মানুষ।
আরও শুনুন: রাত্রিযাপনে খরচ নেই এক পয়সা, তবু কেউ থাকতে নারাজ এই হোটেলে! কেন জানেন?
আর এতদিনে তাই স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে ড. ম্যাথর বলছেন, ‘এই মাত্রার বড় কাজ যখন শুরু করা হয়, তখন সবস্ময়ই একটা সম্ভাবনা থেকে যায় যে, এটা হয়তো কাজ করবে না। কিন্তু আমাদের পরিক্লপনা কাজ করেছে। আর আমরা সে জন্য ভীষণ গর্বিত।’ হ্যাঁ, মানবসভ্যতাই গর্বিত মানুষের এই অর্জনে। আর সেই অর্জন সম্ভব হল যে বিজ্ঞানীদের নিরন্তর সাধনা, মানবসভ্যতা গর্বিত তাঁদের জন্যও।