ব্যারিস্টার মধুসূদন দক্ষিণেশ্বরে এসেছিলেন একটা মামলার কাজে। ডেকে পাঠিয়েছিলেন, মথুরবাবুর ছেলে দ্বারিক। ব্যারিস্টারের সামনে মামলার নথিপত্র তো রাখলেন, কিন্তু দ্বারিকবাবু খেয়াল করলেন, সে সবে যেন মন নেই ব্যারিস্টার সাহেবের। ব্যাপার কী? জানতে চাইলে, মধুসূদন বললেন, একবার শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করা যেতে পারে!
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে বিভিন্ন সময় এসেছিলেন বহু বিখ্যাত মানুষ। স্বক্ষেত্রে খ্যাত হলেও, ঠাকুরের কাছে তাঁরা সন্ধান পেতেন অমৃতজ্ঞানের। আর তাই তাঁদের অনেকে ফিরে ফিরেও আসতেন রামকৃষ্ণ সকাশে। একবার ঠাকুরের মুখোমুখি হয়েছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ঠাকুরের কাছে যাঁরা আসেন, মধুসূদন ঠিক তাঁদের মতো ছিলেন না। একে তো হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়েছেন। তার উপর সুরাপানের প্রতিও ছিল তাঁর তীব্র আসক্তি। সব মিলিয়ে দক্ষিণেশ্বরের সাধনার পরিবেশের সঙ্গে কোনও ভাবেই যেন মানানসই ছিল না মধুসূদনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। আর ঠাকুর তো নিজের সাধনায় বিভোর। এই দুই প্রায় বিপরীত মেরুর মানুষেরই একদিন দেখা হয়ে গেল।
আরও শুনুন: বহমান সমন্বয়ের সংস্কৃতি, প্রভু জগন্নাথ-ই যেন ধরা দিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ রূপে
ব্যারিস্টার মধুসূদন দক্ষিণেশ্বরে এসেছিলেন একটা মামলার কাজে। ডেকে পাঠিয়েছিলেন, মথুরবাবুর ছেলে দ্বারিক। ব্যারিস্টারের সামনে মামলার নথিপত্র তো রাখলেন, কিন্তু দ্বারিকবাবু খেয়াল করলেন, সে সবে যেন মন নেই ব্যারিস্টার সাহেবের। ব্যাপার কী? জানতে চাইলে, মধুসূদন বললেন, একবার শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করা যেতে পারে! দ্বারিকবাবু ভাবলেন, এ আর এমন বড় ব্যাপার কী? ঠাকুর তো নিজের ঘরেই আছেন। তিনি একজন কর্মচারীকে দিয়ে ঠাকুরকে খবর পাঠালেন। মধুসূদন দেখা করতে চাইছেন, শুনে তো তো ঠাকুর যেন আঁতকেই উঠলেন। সাহেব মানুষ মধুসূদন! ইংরেজি বলেন খটোমটো! তাঁর সঙ্গে কী করে কথা বলবেন ঠাকুর? তিনি যে এ-বি-সি-ডি অব্দি জানেন না। কাছেই ছিল ভাগনে হৃদয়। ঠাকুর তাঁকেই পাঠিয়ে দিলেন মধুসূদনের কাছে। কিন্তু যিনি ঠাকুরের দর্শন পেতে চান, হৃদয়রামকে দেখে কি তাঁর সাধ মেটে! অতএব ম্লান মুখে এসে হৃদয় জানালেন, ঠাকুরকে যেতেই হবে। ঠাকুর আর কী করেন! সামনে ছিলেন পণ্ডিত নারায়ণ শাস্ত্রী। তাঁকে সামনে রেখেই গুটিগুটি চললেন, সেই ঘরটার দিকে, যেখানে অপেক্ষা করছেন মধুসূদন।
আরও শুনুন: মানুষ বড় কাঁদছে, মথুরবাবুকে বলে তাঁদের অন্নের ব্যবস্থা করলেন ঠাকুর
এদিকে মাইকেলকে দেখে একটু ক্ষুব্ধই হলেন পণ্ডিতপ্রবর। প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, কেন নিজের ধর্ম ত্যাগ করেছেন তিনি? জবাবে মধুসূদন জানালেন, পেটের দায়ে। তাতে যেন অগ্নিতে ঘৃতাহুতি হল। পণ্ডিত এবার বললেন, পেটের দায়ে কেউ স্বধর্ম ত্যাগ করে? মধুসূদন বললেন, নইলে যে মরে যেতাম। পণ্ডিত বললেন, এই দেহটার জন্য ধর্মকে কেউ তুচ্ছ করে? দেহ কি থাকবে! এই তুচ্ছ কারণে যে ধর্ম ত্যাগ করে তাঁর মুখদর্শন করাও পাপ। এই বলে ক্রুদ্ধ পণ্ডিত উঠে চলে গেলেন।
আরও শুনুন: কবরস্থানে বসেও মা ভবতারিণীর ধ্যান করেছিলেন ঠাকুর
ঠাকুর আর মাইকেলের সামনে এবার আর কোনও আড়াল থাকল না। দুজনে একেবারে মুখোমুখি। মাইকেল ঠাকুরের কাছে জানতে চাইলেন, তিনিও কি তাঁকে ত্যাগ করবেন? উত্তরে সেই ভুবনভোলানো হাসি হেসে ঠাকুর বললেন, আমি কি কাউকে ত্যাগ করতে পারি? আমার কাছে কি অশ্রদ্ধেয়, অপাংক্তেয় বলে কেউ আছে? উত্তর শুনে অবাক হলেন মধুসূদন। এ যাবৎ তিনি প্রত্যাখ্যানই পেয়েছেন। কিন্তু এমন স্নেহের কথা তো শোনেননি। মিনতিভরা চোখে তিনি ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে বললেন, তাহলে আমাকে কিছু বলুন। আমাকে কিছু উপদেশ দিন। ধর্ম ত্যাগ করেছিলেন বটে। তবে ঠাকুরের কাছেই সেদিন শান্তির সন্ধান করলেন মধুসূদন। তারপরই ঘটল এক কাণ্ড। ঠাকুর তাঁকে দুটি কথা বলতে যাবেন, কিন্তু কিছুতেই আর বলে উঠতে পারলেন না। যতবার বলতে যান, ততবারই কে যেন মুখ চেপে ধরেন। কে মুখ চেপে ধরছেন? ঠাকুর বুঝলেন, স্বয়ং মা কালী-ই তাঁকে কথা বলতে দিচ্ছেন না। যে ধর্মদ্রোহী, তাঁকে আবার কীসের উপদেশ! মধুসূদন তখনও ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে আছেন। কাতর অনুনয় করে বলছেন, বলুন কিছু আমাকে। ঠাকুর তখন শরণ নিলেন মায়ের। মাকে বললেন, পাপী-তাপি সকলকেই তুই কোলে ঠাঁই দিস। তাহলে একে কেন দিবিনে? কেন ওর ব্যথার উপশম হবে না? অকস্মাৎ ঠাকুরের মুখের উপর থেকে সরে গেল বাধা। আনন্দময় হাসিতে ভরে উঠল ঠাকুরের মুখ। তিনি বললেন, কথা কইতে দিচ্ছে না। তবে গান-ই শোনাই। মাইকেলকে ঠাকুর বললেন, এই গানেই তুমি শান্তি পাবে।
গান শুরু করলেন ঠাকুর। শুনতে শুনতে দু-চোখ অশ্রুতে ভরে উঠল মাইকেলের।
সেদিন এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন ঠাকুর। মাইকেলের সূত্র ধরেই যেন জগতবাসীকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, হৃদয়ের ভালোবাসায় কোনও বৈরিতা থাকতে পারে না। মানুষকে ভালো না বাসলে ঈশ্বরের পূজা সম্পূর্ণ হয় না। ধর্মত্যাগী মধুসূদনকে তাই পণ্ডিতের মতো তিনি ত্যাগ করেননি। বরং গানে গানেই তাঁকে দিয়েছিলেন শান্তির সন্ধান।