সমাজ থেকে অন্ধকার তাড়াতে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন বিখ্যাত ‘গুলাব গ্যাং’-এর সদস্যরা। পারিবারিক হিংসা, নারীদের প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা। এবার মনের অন্ধকার দূর করতে হাতে ‘অস্ত্র’ তুলে নিলেন একদল বৃদ্ধা। তবে না, প্রচলিত কোনও অস্ত্র নয়, তাঁদের হাতিয়ার শ্লেট-পেনসিল আর মনের জোর। পড়াশোনার আনন্দে তাই মেতেছেন মহারাষ্ট্রের অন্য এক ‘গুলাব গ্যাং’। আসুন, শুনে নিই তাঁদের গল্প।
কারওর বয়স সত্তর পেরিয়েছে, কেউ বা আছেন আশির কোটায়। পরনে গোলাপি শাড়ি, হাতে একটা লাল টুকটুকে ব্যাগ। সকাল দশটা বাজতে না বাজতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন মহারাষ্ট্রের থানে জেলার ফাগানে গ্রামের বৃদ্ধারা। পৌঁছে যান এক কামরার একটা ছোট্ট ঘরে। সেটাই ওঁদের স্কুল। মাটিতে আসন পাতা। গিয়েই চটপট বসে পড়েন যে যার নিজের জায়গায়। ব্যাগ থেকে বেরিয়ে পড়ে শ্লেট আর চক। আজ কি নতুন কিছু শেখার পালা? কারওর বা কপালে চিন্তার ভাঁজ, গতকালের হোমওয়ার্ক শেষ হয়নি পুরোপুরি। দিদিমণি যে বড়ই কড়া!
আরও শুনুন: ‘জঙ্গল ছোড়ব নাহি’… হাতে তির-ধনুক, অরণ্য রক্ষায় একজোট প্রমীলাবাহিনী
শেখার যে কোনও বয়স হয় না তা প্রমাণ করে ছেড়েছেন মহারাষ্ট্রের এই ঠাকুমা-দিদিমারা। তাই স্কুলে পৌঁছতে কোনওদিন দেরি হয় না তাঁদের। সোম থেকে শনি, প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে ১২টা কিংবা ২টো থেকে ৪টে- নিয়মিত দু-ঘণ্টা করে স্কুলে উপস্থিত থাকেন ফাগানে গ্রামের সমস্ত বৃদ্ধা। কেউ আগে শুধু সইটুকু করতে জানতেন, কেউ বা ছিলেন একেবারেই অক্ষরজ্ঞানহীন। সব মিলিয়ে এই স্কুলে এখন মোট ৩৫ জন পড়ুয়া। শিক্ষিকা একজনই। বছর তিরিশের শীতল মোরে। তিনি নিজে অবশ্য পড়াশোনা করেছেন দশম শ্রেণি পর্যন্ত। নিজে যেটুকু যা জানেন, তা ওই বৃ্দ্ধাদের অক্ষর বা সংখ্যা পরিচয়ের জন্য যথেষ্ট। সময় পেলে অবশ্য এই স্কুলে পড়ান এলাকার জেলা পরিষদ স্কুলের শিক্ষক এবং সমাজকর্মী যোগেন্দ্র বাঙ্গারও। তাঁর উদ্যোগেই চালু হয়েছিল এই পাঠশালা। ২০১৬ সালের ৮ মার্চ। নারী দিবসের দিন, স্থানীয় বৃদ্ধাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই শিক্ষালয়। যোগেন্দ্র মনে করেন, শেখার কোনও বয়স হয় না। আর এই জ্ঞান বা শিক্ষা মানুষকে বাঁচার মানে খুঁজে দিতে পারে। বয়স্ক মানুষগুলোর আত্মবিশ্বাস ফেরাতেই এই স্কুল শুরু করেছিলেন তিনি।
আরও শুনুন: ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে সবুজের অভিযানে! আস্ত শহরকে গাছপালায় সাজিয়ে তুলেছেন লতিকা
মরাঠি ভাষায় অক্ষর পরিচয়, তো কখনও ছোটদের ছড়া- ঠাকুমা-দিদিমারা এসবই পড়েন তাঁদের স্কুলে। অনেকেই এতদিন ভাবতেন, জীবনে একটাও ধর্মগ্রন্থ কি নিজে থেকে পড়তে পারব না কোনওদিন? কেউ বা অর্থাভাবে কোনওদিন স্কুলের মুখই দেখেনি। তাঁদের সেই স্বপ্নই পূরণ হচ্ছে এখন। শীতলের তদারকিতে আস্তে আস্তে অনেক কিছুই শিখছেন তাঁরা। শুধু স্কুলের পড়াশোনা নয়, থাকে হোমওয়ার্কও। কোথাও আটকালে তাঁদের সাহায্য করে বাড়ির খুদে নাতি-নাতনিরা। ইদানীং ব্যাঙ্কেও একা-ই যাচ্ছেন বৃদ্ধারা। আর টিপ সই নয়। গর্বের সঙ্গে নিজের নাম লিখে আসেন তাঁরা দরকারি কাগজপত্রে। এর সঙ্গে সঙ্গে স্কুলে আরও একটা কাজ থাকে তাঁদের। ছাত্রীদের প্রত্যেকের জন্য ধার্য করা হয়েছে একটি করে চারাগাছ। সেই গাছের যত্নআত্তি ও বড় করার দায়িত্বও রয়েছে গোটাটাই তাঁদের কাঁধে।
সব মিলিয়ে ফাগানে গ্রামের বৃদ্ধাদের জন্য এই স্কুল যেন একটা অন্য আকাশ। সংসারের ঘেরাটোপ থেকে টেনে বের করে এনে যা তাঁদের দিয়েছে মুক্তির স্বাদ। অশিক্ষার অন্ধকার আর রক্ষণশীলতা থেকে বেরিয়ে নতুন করে জগৎকে চিনতে শিখছেন মহারাষ্ট্রের এই নতুন ‘গুলাব গ্যাং’।