ভারতবর্ষের সনাতন ধর্মের ভিতর যে অপূর্ব সমন্বয়ের সংস্কৃতি নিহিত আছে, প্রভু জগন্নাথদেব তাঁরই মূর্ত প্রতীক। বহু পথ, বহু মত, বধু সাধনার ধারা এসে মিলেছিল তাঁরই পাদপদ্মে। আর এ যুগে এসে সেই যত মত তত পথের বাণী, সেই সমন্বয়ের সাধনার মন্ত্র-ই তো শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ।
জীবদ্দশায় কখনও শ্রীক্ষেত্রে যাননি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব। বলতেন, একবার মহাপ্রভুর দর্শন হলে, ওই মহাভাবে আর বোধহয় শরীর রক্ষা করা সম্ভব হবে না। পূর্বলীলার কথা স্মরণ করে আর হয়তো নিজেকে সামলাতে পারবেন না তিনি। ঠাকুরের এই কথাটুকুর ভিতরই নিহিত আছে এক অপূর্ব ইঙ্গিত। ঠাকুর তো নিজেই একদিন হাটে হাঁড়ি ভেঙে বলে গিয়েছিলেন, যিনি রাম যিনি কৃষ্ণ তিনি-ই এক দেহে শ্রীরামকৃষ্ণ রূপে উপস্থিত এই ধরাধামে। আর প্রভু জগন্নাথ সম্পর্কে তাঁর এই উক্তি থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি, এই যুগে জগন্নাথবিগ্রহ হয়েই যেন অবতীর্ণ হয়েছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। মাস্টারমশাই শ্রীম-কে তো মুখ ফুটে একবার বলেও গিয়েছিলেন সে-কথা। নিজে না গেলেও শ্রীম-কে বেশ কয়েকবার শ্রীক্ষেত্রে পাঠিয়েছিলেন ঠাকুর। বেশ কৌশল করেই তিনি প্রভুকে আলিঙ্গন করে এসেছিলেন। আর তিনি ফিরতেই ঠাকুর তাঁকে আলিঙ্গনে বদ্ধ করে বলেছিলেন, এই আমারও জগন্নাথ আলিঙ্গন হয়ে গেল। পরবর্তীকালে ঠাকুরের এই জগন্নাথ-সত্তার আভাস দিয়েছিলেন স্বয়ং শ্রীমা। সেবার রথযাত্রার দিনে বাগবাজারে মায়ের বাড়িতেই ছিলেন জগজ্জননী দেবী সারদা। রথ সাজানো হয়েছে। তার উপর রাখা হয়েছে ঠাকুরের পট। সেদিন শ্রীমা বলেছিলেন, সকলেই তো জগন্নাথ দর্শনে যেতে পারেন না, তাই এখানে যাঁরা দর্শন করবেন, তাঁদেরও হবে। অর্থাৎ রথে উপবিষ্ট জগন্নাথ দর্শনের সম পুণ্য লাভ হবে রথোপবিষ্ট ঠাকুরের দর্শনেও। করুণামইয়ী মায়ের এ-কথা আমাদের স্পষ্টই জানিয়ে দেয়, প্রভু জগন্নাথ-ই যেন এ-যুগে ধরাধামে এসেছিলেন কল্পতরু শ্রীঠাকুর হয়ে।
আরও শুনুন: রথে উপবিষ্ট জগন্নাথদেবকে দর্শন করলে আর থাকে না পুনর্জন্মের ভাবনা
ঠাকুর নিজেও অংশ নিয়েছিলেন রথযাত্রায়। মাহেশের রথের রশি ছুঁয়েছিলেন ঠাকুর। ভক্তস্মৃতিতে গাঁথা হয়ে আছে সেই দিব্যলীলার কথা। কলকাতায়, ঠাকুরের পরম ভক্ত, বলরাম বসু ছিলেন প্রভু জগন্নাথের একনিষ্ঠ সাধক। হয়তো শ্রীক্ষেত্রে-ই তিনি থেকে যেতে পারতেন আজীবন। পারিবারিক অনুরোধে জগন্নাথভূমি ছেড়ে ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়। তবে ঠাকুরের করুণালাভ করার পর তাঁকে আর সেখানে ফিরতে হয়নি। পূর্ণ হয়েছিল তাঁর ঈশ্বরদর্শনের অভিলাষ। ভক্ত বলরাম শ্রীক্ষেত্রে যেতেন প্রভুকে দর্শন করতে; আর কলকাতায় ফেরার পর তাঁর বাড়িতে নিজে এলেন করুণাময় শ্রীঠাকুর। এই বলরাম বাটীতেই রথযাত্রায় শামিল হয়েছিলেন শ্রীমাওকৃষ্ণ। ১৮৮৪ সালের উলটো রথের দিন ভক্তের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছিলেন ঠাকুর। কথামৃতকার সেদিনের বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, বলরামের বৈঠখানায় ঠাকুর মজলিস করে বসে আছেন। আনন্দময় তাঁর মূর্তি। পরম আনন্দে কথা বলছিলেন ভক্তদের সঙ্গে। পরের বছর অর্থাৎ ১৮৮৫ সালের রথযাত্রাতেও পুনর্যাত্রার দিন ঠাকুরের পদধূলি পড়ে বলরাম-বাটীতে। লীলাপ্রসঙ্গে সেদিনের স্মৃতি তুলে ধরেছেন স্বামী সারদানন্দ মহারাজ। তিনি লিখছেন, ‘এই বাটীতে শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের সেবা ছিল, কাজেই রথের সময় রথটানাও হইত; কিন্তু সকলই ভক্তির ব্যাপার, বাহিরের আড়ম্বর কিছুই নাই। বাড়ি সাজানো, বাদ্যভাণ্ড, বাজে লোকের হুড়াহুড়ি, গোলমাল, দৌড়াদৌড়ি – এ সবের কিছুই নাই। ছোট একখানি রথ, বাহিরবাটীর দোতলার চকমিলান বারান্দায় চারিদিকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া টানা হইত – একদল কীর্তনীয়া আসিত, তাহারা সঙ্গে সঙ্গে কীর্তন করিত, আর ঠাকুর ও তাঁহার ভক্তগণ ঐ কীর্তনে যোগদান করিতেন। কিন্তু সে আনন্দ, সে ভগবদ্ভক্তির ছড়াছড়ি, সে মাতোয়ারা ভাব, ঠাকুরের সে মধুর নৃত্য – সে আর অন্যত্র কোথা পাওয়া যাইবে? সাত্ত্বিক পরিবারের বিশুদ্ধ ভক্তিতে প্রসন্ন হইয়া সাক্ষাৎ ৺জগন্নাথদেব রথের বিগ্রহে এবং শ্রীরামকৃষ্ণশরীরে আবির্ভূত – সে অপূর্ব দর্শন আর কোথায় মিলিবে? সে বিশুদ্ধ প্রেমস্রোতে পড়িলে পাষণ্ডের হৃদয়ও দ্রবীভূত হইয়া নয়নাশ্রুরূপে বাহির হইত – ভক্তের আর কি কথা! এইরূপে কয়েক ঘণ্টা কীর্তনের পরে শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের ভোগ দেওয়া হইত এবং ঠাকুরের সেবা হইলে ভক্তেরা সকলে প্রসাদ পাইতেন।’
আরও শুনুন: যত মত তত পথ – সমন্বয়ের এই বাণীই মানবের চালিকাশক্তি
ভারতবর্ষের সনাতন ধর্মের ভিতর যে অপূর্ব সমন্বয়ের সংস্কৃতি নিহিত আছে, প্রভু জগন্নাথদেব তাঁরই মূর্ত প্রতীক। বহু পথ, বহু মত, বধু সাধনার ধারা এসে মিলেছিল তাঁরই পাদপদ্মে। আর এ যুগে এসে সেই যত মত তত পথের বাণী, সেই সমন্বয়ের সাধনার মন্ত্র-ই তো শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। রথযাত্রার মিলনোৎসবে শ্রীমার সেই বাণী তাই আমরা স্মরণ করি- ঠাকুরের দর্শন-ই প্রভু জগন্নাথের দর্শন।