মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের সঙ্গে তরুণ মজুমদারের ছিল অপূর্ব সখ্য। দুজনের সম্পর্কে যেমন টানাপোড়েন এসেছে, তেমনই স্নেহছায়ার অপরূপা প্রতিমা হিসাবেও তরুণবাবুর সামনে প্রতিভাত হয়েছিলেন স্বয়ং সুচিত্রা সেন। আসুন শুনে নিই, বাংলা ছায়াছবির জগতের দুই মহারথীর গল্প।
সিনেমাপাড়ায় যখন যুবক তরুণ মজুমদার পা রেখেছিলেন, তখন অদ্বিতীয় ‘ম্যাডাম’ ছিলেন একজনই – তিনি কানন দেবী। পরবর্তীকালে অবশ্য সে অভিধা পান সুচিত্রা সেন। এ গল্প যখনকার, তখনও তিনি মহানায়িকা হয়ে ওঠেননি। সে সময় তরুণবাবুও হননি খ্যাতনামা পরিচালক। বাংলা ছবিতে তখন চলছে এক সোনালি অধ্যায়ের সূচনাপর্ব।
আরও শুনুন: ‘নিজে ছবি ডিরেক্ট করছেন না কেন?’ সিনেমাপাড়ার তরুণকে পরিচালনায় আসার ডাক উত্তমকুমারের
সেই সময়ই একটা ছবির শুটিং চলছে। ক্যামেরার এদিকে তরুণ মজুমদার, ওদিকে সুচিত্রা সেন। সহ-অভিনেতা অসিতবরণ। বেশ লম্বা একটা শট। টানা সংলাপ। আবার একটি বাচ্চাও আছে সেখানে। তাকে কোলে নিয়েই সিনটা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে সুচিত্রা সেনকে। কঠিন শট, নিঃসন্দেহে। সুচিত্রা অত্যন্ত মন দিয়ে কাজটা করছেন। কিন্তু বাচ্চাটার জন্য বারংবার শট নাকচ হয়ে যাচ্ছে। তাতেও ধৈর্য্য হারাচ্ছেন না সুচিত্রা। মন দিয়ে কাজ করে চলেছেন। একবার শট প্রায় শেষ, এমনসময় বাচ্চাটা নড়েচড়ে উঠল। তাকে সামলে নিয়েই উপস্থিত বুদ্ধিতে শটটা শেষ করতে চাইলেন সুচিত্রা। কিন্তু পাল্লা দিতে পারলেন না অসিতবরণ। এবার ধৈর্য্যচ্যুতি হল মিসেস সেনের। বাচ্চাটিকে কোল থেকে নামিয়ে তরুণ মজুমদারের সামনে এসে বললেন, ‘এমন আর্টিস্টের সঙ্গে কাজ করা যায়? অসম্ভব!’ অসিতবরণ বর্ষীয়ান অভিনেতা। তাঁর সম্পর্কে এরকম বলায় গোটা ফ্লোর থমথমে। অসিতবরণের মুখেও তখন মেঘ নেমেছে। সেই সময় তরুণবাবু এমন একটা কথা বলে ফেললেন, যা বোধহয় কেউ স্বপ্নেও ভাবেননি। সুচিত্রা সেনের চোখে চোখ রেখে সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘ওঁর সঙ্গে কাজ করা যায় কি না তা পরের কথা। কিন্তু যা ব্যবহার করলেন আপনার মতো আর্টিস্টের সঙ্গেও কাজ করা যায় না।’ মুহূর্তে ফ্লোর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন সুচিত্রা। একটু পরে সকলেই বুঝতে পারলেন শুটিং মোটামুটি পণ্ড। স্বয়ং সুচিত্রা সেন রেগে বেরিয়ে গিয়েছেন বলে কথা! তরুণবাবু ঠিক করলেন, প্রযোজকের ক্ষতি করার দরকার নেই। তিনিই বরং ছবি ছেড়ে দেবেন।
কিন্তু এ গল্পের এখানেই শেষ নয়। গল্পের বাকি অংশেই তরুণবাবু জানিয়ে দেবেন, কেন সুচিত্রা সেন ক্রমে হয়ে উঠেছিলেন মহানায়িকা। সেদিন ওই ঘটনার পর, ফ্লোরে সবাই ইতিউতি ঘুরছেন। একা বসে আছেন তরুণবাবু। এমন সময় সেই নির্জন ফ্লোরে নিজেই চলে এলেন ম্যাডাম সেন। তরুণবাবুকে ডেকে বললেন, একবার যেন অসিতবরণকে ডাকা হয়। সকলের সামনে তিনি ক্ষমা চেয়ে নেবেন। সেদিন সকলেই বুঝেছিলেন, সুচিত্রা সেন একজন ভিন্ন গোত্রের মানুষ। সুচিত্রা সেন ক্ষমা চাইতেই ঝঝরিয়ে কেঁদে ফেললেন অসিতবরণ। সেদিনকার মতো ঝামেলা মিটে গেলে, আবার শুরু হল শুটিং।
আরও শুনুন: প্রয়াত তরুণ মজুমদার, ‘সিনেমাপাড়া দিয়ে’ পথচলা থামল নির্জন পথের পথিকের
এরপর থেকেই তরুণবাবু লক্ষ্য করেন, ম্যাডাম সেনের ব্যবহারে সূক্ষ্ম এক পরিবর্তন এসেছে। আর-একদিন শুটিং চলকালীন খুব জ্বর এল তরুণবাবুর। বন্ধু-পরিচালকদের কাজ চালিয়ে নিতে বলে তিনি একটা ঘুপচি মতো জায়গায় এসে কোনক্রমে শুয়ে পড়েছিলেন। জ্বরের ঘোরে কিংবা ঘুমে কোথায় খানিকক্ষণ যেন হারিয়ে গেলেন তরুণবাবু। যখন সংবিৎ ফিরল দেখলেন, আশেপাশে যেন আরও কেউ আছেন। তিনি একা নেই। একটু ধাতস্থ হয়ে চমকে খেয়াল করলেন, পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন স্বয়ং সুচিত্রা সেন। অন্যান্যরাও ছিলেন। তরুণবাবুকে জাগতে দেখে, সুচিত্রা জানতে চাইলেন, তিনি সুস্থ বোধ করছে কি-না! ফ্লোরে আসতে পারবেন কি-না! তরুণবাবু বন্ধুদের দেখিয়ে বললেন, এঁরা তো আছেন। কিন্তু সুচিত্রা সেনের একটাই কথা, তরুণবাবু যেন ক্যামেরার পিছনে গিয়ে দাঁড়ান। অন্তত দাঁড়াতে না-পারলেও যেন বসে দেখেন, শটগুলো ঠিকঠাক হচ্ছে কি-না। ‘কাট-ইট’ এই শব্দবন্ধটুকু তিনি তরুণ মজুমদারের মুখ থেকেই শুনতে চান।
বাংলা ছবির জগৎ ছিল এমনটাই। ‘সিনেমাপাড়া দিয়ে’ ভ্রমণের ইতিবৃত্ত লিখে রাখতে গিয়ে রূপোলি জগতের এই সোনালি দিনেরই সন্ধান আমাদের দিয়ে গিয়েছেন এক এবং অদ্বিতীয় তরুণ মজুমদার।
তথ্যঋণ: সিনেমাপাড়া দিয়ে / তরুণ মজুমদার / দে’জ