পরিচালক তরুণ মজুমদার বাংলা ছবিকে যে ঐশ্বর্য উপহার দিয়েছেন, তা আমাদের চিরকালীন সম্পদ। এই তরুণববাবু যখন সিনেমাপাড়ায় নেহাতই তরুণ, স্বপ্ন দেখছেন নিজে সিনেমা করার, তখন পাশে এসে কে দাঁড়িয়েছিলেন জানেন? আর কেউ নন, স্বয়ং উত্তমকুমার। বলা যায়, সেদিনের তরুণ সিনেমাপ্রেমীকে পরিচালনার পথে এনেছিল উত্তমকুমারের আহ্বানই। আসুন শুনে নেই সেদিনের গল্প।
‘পলাতক’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘বালিকা বধূ’, ‘ফুলেশ্বরী’-র মতো ছবি যিনি উপহার দিয়েছেন, তিনি এক এবং অদ্বিতীয় তরুণ মজুমদার। সাধারণ জীবনের ভিতর থেকে তুলে আনা অসামান্য কাহিনি যখন তিনি তুলে ধরতেন রূপোলি পর্দায়, বাঙালি যেন সেই সব রূপোলি আখ্যানে খুঁজে পেত নিজেকেই। সময় পেরিয়েও তাই তরুণবাবুর ছবি আমাদের বুঁদ করে রাখে। সেই তরুণবাবুর পরিচালনায় আসার নেপথ্যে থেকে গিয়েছে আর-এক মানুষের অবদান। তিনি উত্তমকুমার।
আরও শুনুন: ‘আপনার ফ্লোরে থাকা দরকার’ জ্বরে কাতর তরুণ মজুমদারের পাশে দাঁড়ালেন স্বয়ং সুচিত্রা
আমবাঙালির কাছে উত্তমকুমার মহানায়ক। স্টারডমের সীমানা পেরিয়ে তিনি এখন বাঙালির মঙ্গলকাব্যে মিথে রূপান্তরিত হয়েছেন। কিন্তু এই সাধারণ চেনার বাইরে যে উত্তমকুমার, তার খবর হয়তো বেশি কেউ জানতেন না। তরুণ মজুমদারের মতো গুটিকয় মানুষ, যাঁরা উত্তমকুমারকে দেখেছেন গোড়ার দিনে, তাঁরাই চিনতেন সেই অচেনা উত্তমকে। সে-উত্তম মহানায়কের খ্যাতিতে আটকে থাকা উত্তম নন। বরং এটায় সেটায় ‘হ-রি-বো-ল’ বলে চেঁচিয়ে ওঠা উত্তম। নায়ক হয়েও কলাকুশলীদের সঙ্গে যাঁর অনায়াস সম্পর্ক। এমনকী কলাকুশলীরা ঠিকমতো খাবার পাচ্ছেন না জেনে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন। ফিরিয়ে দেন নিজের খাবার। সেই অচেনা উত্তমই যেন একদিন তরুণবাবুকে টেনে এনেছিলেন পরিচালনার পথে।
আরও শুনুন: প্রয়াত তরুণ মজুমদার, ‘সিনেমাপাড়া দিয়ে’ পথচলা থামল নির্জন পথের পথিকের
হরিদাস ভট্টাচার্যের পরিচালনায় ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ ছবির আউটডোর শুটিং তখন চলছে রাজগিরে। হঠাৎ এক দুর্ঘটনার জেরে টাকাপয়সায় বেশ টান পড়ল। কিন্তু শুটিং তো বন্ধ করলে চলে না। অতএব নায়ক ছাড়া অন্যান্য টেকশিয়ানদের খাওয়া-দাওয়ায় কিঞ্চিৎ টান পড়ল। লাঞ্চ বলতে হাতে আসছে একটা ঠোঙায় দুটো শিঙাড়া আর জিলিপি। তাই সই! এই সব নিয়েই হাসিমুখে সকলে কাজ করছেন। সেবারের শুটিং-এ ঘটল এক ঘটনা। একদিন লাঞ্চব্রেকে তরুণবাবু আর তাঁর বন্ধু দিলীপবাবু গল্প করতে করতে একটা ফাঁকা জায়গার দিকে এগিয়ে গিয়েছেন। হঠাৎ চোখে পড়ল এক অপূর্ব দৃশ্য। বেলা পড়ে এসেছে। গমের খেতে এসে পড়েছে পড়ন্ত বেলার হলদে আলো। ঠিক যেন ব্যাক লাইট। আর সেই আলো গায়ে মেখে ফিরে যাচ্ছে শুটিং-এ আসা বয়েল গাড়িগুলি। ধুলো উড়ে যেন মেঘের আড়াল তৈরি করছে। সেই ধুলোমেঘের ভিতর থেকে একবার গাড়িগুলো দেখা দিচ্ছে, পরক্ষণেই মিলিয়ে যাচ্ছে। এই অপূর্ব দৃশ্য দেখে তন্ময় হয়ে গেলেন তরুণবাবু। খেয়াল করেননি, কখন চলে গেছেন দিলীপবাবু। নিজের মনেই বলতে থাকলেন, এরকম একটা দৃশ্য যদি ছবিতে রাখা যেত! আর ঠিক তখনই পিছন থেকে কে যেন বলে উঠলেন, ‘আপনি নিজে ছবি ডিরেক্ট করছেন না কেন?’ যিনি বললেন, তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং উত্তমকুমার।
সেদিন সন্ধেবেলায় নিজের ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন উত্তমকুমার। খোঁজ করলেন তরুণবাবুর। তারপর কাছে গিয়ে বলেছিলেন, তিনি কিন্তু ঠাট্টা করেননি। সত্যি সত্যিই ছবি পরিচালনা করতে বলেছেন। তখনও তরুণবাবু যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। স্বপ্ন দেখেন বটে, তবে প্রোডাকশনের সামান্য ‘অবজার্ভার’ তিনি, তিনি আবার ছবি করবেন কী! সেদিন ভরসা দিয়ে তরুণ মজুমদারকে উত্তমকুমার বলেছিলেন, ‘যদি কোনোদিন স্বাধীন ভাবে ছবি করেন, কথা দিচ্ছি, আমি পাশে থাকব- অবশ্য যদি আপনার চিত্রনাট্যে মানিয়ে যায়।’
‘সিনেমাপাড়া দিয়ে’ হেঁটে-চলা জীবনের ইতিবৃত্ত লিখতে গিয়ে এই দিনটিকে সোনার দিন হিসাবেই উল্লেখ করেছেন তরুণবাবু, লিখেছেন, ‘এরপর আমার ভাগ্যের দরজাটা খুলে গেল’। উত্তমকুমারের সেদিনের ডাক বিফল যায়নি। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়েই, তরুণবাবু আর তাঁর দুই বন্ধু মিলে তৈরি করেছিলেন ‘চাওয়া পাওয়া’। বাংলা সিনেমাজগৎ পেয়েছিল এক চিরন্তন ছবি আর এক ক্ল্যাসিক পরিচালককে।
তথ্যঋণ: সিনেমাপাড়া দিয়ে / তরুণ মজুমদার / দে’জ