এ দেশকে কৃষ্ণনামের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন যিনি, সেই চৈতন্যদেব জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে ভালবাসার মন্ত্রও দিয়েছিলেন। ধর্মীয় বাঁকবদলের সূত্র ধরে সেকালের সমাজে প্রচলিত উঁচু নিচু ভেদাভেদের বেড়া অনেকাংশে মুছে দিয়েছিলেন তিনি। সম্প্রতি কৃষ্ণভক্তির পথ ধরে যেন তেমনই মানবপ্রেমের পরিচয় মিলল যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে। উদ্বাস্তু মানুষের পাশে এসে দাঁড়ালেন কৃষ্ণভক্তেরা। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
“জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।” এই বাণী ভারতবর্ষের মূলমন্ত্র। এই ভারতের সাগরতীরে যত মহামানবের দেখা মিলেছে, তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন বয়ানে বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন এই কথাটিই। যেমন মনে করিয়ে দিয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যও। একদিকে সমাজের উচ্চবর্গের, উচ্চবর্ণের মানুষ; আরেকদিকে ডাকাত জগাই মাধাই, আবার যবন হরিদাস- কৃষ্ণনামের তলায় সকলকেই ডেকে নিয়েছিলেন তিনি। জাতি-শ্রেণি-বর্ণের ভেদাভেদ মুছে দিতে চেয়েছিলেন প্রেমের মন্ত্রে। পরবর্তীকালে কৃষ্ণভক্তির পথে গড়ে উঠেছে একাধিক ধর্মীয় সংগঠন, দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে তাদের কর্মকাণ্ড, তবে সেই মানবপ্রেমের সুরটি আজও বেজে চলেছে নানাভাবেই। সম্প্রতি যেন সে কথারই প্রমাণ মিলল যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে। যুদ্ধের জেরে ঘরছাড়া হয়েছেন সে দেশের যত মানুষ, তাঁদের একটা বড় অংশের ঠাঁই হয়েছে উত্তর আয়ারল্যান্ডের এক হরেকৃষ্ণ মন্দিরে। জানা গিয়েছে, ইস্কনের ওই মন্দিরটিকেই নিরাপদ আশ্রয় বলে বেছে নিয়েছেন ইউক্রেনের উদ্বাস্তু কৃষ্ণভক্ত মানুষেরা। আর তাঁদের কাউকেই ফেরায়নি এই মন্দির।
আরও শুনুন: অফিসের ধর্মীয় প্রার্থনাসভায় যোগ দিতে নারাজ, দুই কর্মীকে বরখাস্ত করল সংস্থা
চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ হামলায় কেঁপে উঠেছিল ইউক্রেন। তারপর থেকে যত দিন গড়িয়েছে, দেশটির উপরে ক্রমশ চেপে বসেছে রাশিয়ার থাবা। আন্তর্জাতিক মহলের একাধিক হুঁশিয়ারিতেও ফল মেলেনি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাতে এখন চারদিকে কেবল ধ্বংসের চিহ্ন। মিলছে না খাবার কিংবা প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রও। বহু মানুষের মাথার উপরে ছাদটুকুও নেই। এ অবস্থায় যুদ্ধ চললে, স্রেফ ঠান্ডায় বহু মানুষ মারা যাবেন বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। ইতিমধ্যেই রুশ আক্রমণে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে সে দেশের বড় শহর মারিওপোল। এবার জানা গেল, সেই শহরের কৃষ্ণভক্ত মানুষেরা অনেকেই পাড়ি জমিয়েছেন আয়ারল্যান্ডে। সেখানকার জঙ্গলে ঘেরা একটি দ্বীপে ১৯৮০ সালে এক হরেকৃষ্ণ মন্দির গড়ে তুলেছিল ইস্কন। লোকচক্ষুর প্রায় আড়ালে থাকা সেই মন্দির এতদিন কৃষ্ণসেবা নিয়েই ব্যস্ত ছিল। কিন্তু ইউক্রেনের এই বিপদের দিনে সে দেশ থেকে পালিয়ে আসা ভক্তদের আশ্রয় দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি এই মন্দির। অথচ এই দ্বীপটি বাইরের শহর এলাকা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। স্থলভাগ থেকে দ্বীপে পৌঁছতে গেলে নৌকা ছাড়া গতি নেই। ফলে রসদ, পানীয় জল, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র- কোনও কিছুই সেখানে সুলভ নয়। সমস্ত কাজই করতে হয় নিজেদের হাতেই। এই পরিস্থিতিতেও ইউক্রেনের ঘরছাড়া ভক্তদের ফেরায়নি মন্দিরটি। আবার দেশ থেকে প্রাণ নিয়ে পালানোর পর, এই নির্জন মন্দিরটিকেই নিরাপদ বলে আঁকড়ে ধরেছেন ভক্তরা। এই মন্দির কেবল তাঁদের আশ্রয়ই দেয়নি, যুদ্ধের ভয়াবহতা তাঁদের মনে যে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত ফেলে গিয়েছে, তার থেকেও মুক্তি দিয়েছে- এমনটাই জানিয়েছেন ওই ভক্তরা।