কেবল বয়স বাড়লেই কি ভুলে যায় লোকে? উঁহু। ব্যাপারটা আসলে ঠিক তার উলটো। বয়স বাড়লে আপনি ভুলে যাবেন কি যাবেন না, তার নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু ছোটবেলায় যে আপনার স্মৃতিভ্রংশ হবেই, এ কথা একবাক্যে মেনে নিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ইনফ্যান্টাইল অ্যামনেশিয়া, অর্থাৎ শৈশবের এই স্মৃতিভ্রংশের কারণ কী জানেন? আসুন, শুনে নেওয়া যাক সে কথা।
মানুষের স্মৃতিকে তার আরেক বাসভূমি বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নিজের যে সত্তা অতীতে হারিয়ে গিয়েছে, স্মৃতির মধ্যে সেই ‘আমি’-কে বাঁচিয়ে রাখে মানুষ। স্মৃতির মধ্যেই তাই মানুষের অনেকখানি বেঁচে থাকে। আর সেই কারণেই, স্মৃতি হারালে ঠাঁইনাড়া হওয়ার মতো অনুভূতি হয় তার। কিন্তু জানেন কি, কেবল বয়স বাড়লেই যে মানুষ পুরনো স্মৃতি হারিয়ে ফেলে এমনটা নয়, কম বয়সেও ঘটতে পারে এমনটা? দেখা গিয়েছে, মোটামুটি দুবছর বয়সের আগের কথা মনে রাখতে পারেন না কেউই। এই অবস্থাকেই ইনফ্যান্টাইল অ্যামনেশিয়া, অর্থাৎ শৈশবের স্মৃতিভ্রংশ বলে চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু কেন হয় এমন? তাহলে শুনে নেওয়া যাক, কী বলছেন বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা।
আরও শুনুন: কন্যাসন্তান জন্মালেই রোপণ ১১১টি চারা গাছ, কোথায় পালিত হয় এই প্রথা?
সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছে, একেবারে শৈশবে যে মানুষের কোনও স্মৃতি থাকে না এমন নয়। স্মৃতি বলতে আমরা যা বুঝি, টুকরো টুকরো ছবি আর গল্পের কোলাজ, শিশুর স্মৃতি ঠিক তেমন নয়। কিন্তু কয়েক মাস বয়সের শিশুও যে মুখগুলিকে ঘন ঘন দ্যাখে, সেই মুখগুলি মনে রাখতে পারে। আশির দশকে এক সমীক্ষা করেন মনস্তত্ত্ববিদ ক্যারোলিন রোভি কলিয়ার এবং তাঁর সহযোগীরা। দুই থেকে ছয় মাসের শিশুদের পায়ের সঙ্গে একটি ঝুলন্ত মোবাইল ফোনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে দিয়েছিলেন তাঁরা, যাতে পা নাড়ালেই ফোনটি নড়ে ওঠে। দেখা গিয়েছিল, কিছুক্ষণ এই কাজ করলে দু-একদিন পরেও ফোন দেখে একইভাবে পা নাড়াচ্ছে সেই শিশুরা। কিন্তু এসবের কোনও কিছুই তো আত্মজৈবনিক নয়, অর্থাৎ নিজের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। সেই জাতীয় কোনও স্মৃতি কিন্তু দু-তিন বছর বয়স হওয়ার আগে মনে রাখতে পারে না কেউই। এই না-পারার কারণ কী হতে পারে, তা নিয়ে কোনও স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছনো না গেলেও কয়েকটি কারণ অনুমান করেছেন বিজ্ঞানীরা।
তাঁদের মতে, প্রথমত, অটোবায়োগ্রাফিক্যাল বা আত্মজৈবনিক স্মৃতি গড়ে তোলার জন্য আত্ম বা সেলফ-এর বোধ গড়ে ওঠা দরকার, যা একান্ত শিশু বয়সে তৈরি হয় না। ১৮ মাসের কম বয়সি শিশুর গালে রুজ পাউডার লাগিয়ে তাকে আয়নার সামনে নিয়ে গিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, সে কিন্তু নিজেকে চিনতে পারছে না।
আরও শুনুন: মা-বাবা ‘লিভ ইন’ করলেও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে সন্তান, রায় সুপ্রিম কোর্টের
দ্বিতীয়ত, দু বছরে পা দেওয়ার আগে পর্যন্ত শিশুরা ভাষা দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না। ফলে কোনও ঘটনাকে মনের মধ্যে গল্পের মতো সাজিয়ে নেওয়াও তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
আর সবচেয়ে বড় যে কারণটিকে বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করেছেন, তা হল, মানবমস্তিষ্কের যে অংশটি স্মৃতি গড়ে তোলে এবং জমিয়ে রাখে, সেই হিপোক্যাম্পাস শৈশবে ঠিকমতো গড়েই ওঠে না।
তবে এই কারণগুলি অনুমান করলেও এখনও কোনও নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। ঠিক কী কারণে দুবছর বয়সের আগের কোনও স্মৃতি মানুষের মনে থাকে না, সে বিষয়ে আরও পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছেন তাঁরা।