জামাইষষ্ঠী নিয়ে গল্পের শেষ নেই। অরণ্যষষ্ঠীর সঙ্গে এর যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন কেউ কেউ। কেউ আবার টেনেছেন অন্য গল্পের প্রসঙ্গ। উৎস, ইতিহাস পেরিয়ে হাল আমলের জামাইষষ্ঠী অবশ্য অনেকটাই পারিবারিক গেট-টুগেদার। জামাইষষ্ঠীর সেকাল থেকে একাল- ইতিবৃত্ত সন্ধানে রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
“মোরা দুজনায় রাজার জামাই!” … গেয়েছিল গুগাবাবা। তা রাজার জামাই কি আর সকলেই হতে পারেন! গুপি গাইন আর বাঘা বাইন নয় স্পেশাল। তাই বলে কি বাকি সব জামাইরা ফেলনা! উঁহু মোটেও নয়। বাঙালির ঘরদোরে একটা দিন অন্তত বরাদ্দ আছে, যেদিন জামাই মাত্রই নিজেকে রাজাগজা মনে করতে পারেন। সে জামাই দোর্দণ্ডপ্রতাপ হোন কি ছাপোষা পেটরোগা – কুছ পরোয়া নেহি। এই একটি দিনে জামাই নিজেই রাজা। জামাই আদরের ঢেউ ওঠে ঘরে ঘরে। হ্যাঁ, এক্কেবারে ঠিক ধরেছেন, জামাইষষ্ঠীর কথাই বলছি।
আরও শুনুন: ঠকাতে হবে নতুন জামাইকে! জামাইষষ্ঠী উপলক্ষ্যেই বাঙালির পাতে এল ‘জলভরা’
এই যে একটা দিন চর্ব্য-চূষ্য-লেহ্য-পেয় দিয়ে জামাইকে সন্তুষ্ট রাখার আয়োজন, তার উৎসটি আসলে কোথায়? এমনিতে দেবী ষষ্ঠী হলেন সন্তানলাভের দেবী। তিনি একদিকে যেমন মাতৃত্বের প্রতীক, আরেকদিকে শিশুর রক্ষাকর্ত্রীও বটে। আদরের সন্তানটিকে ‘ষেঠের বাছা’ অর্থাৎ ষষ্ঠীর বাছা বলার মধ্যেই ইঙ্গিত রয়েছে, সকল শিশুর আদি বাস মা ষষ্ঠীর কাছেই। আর সেইজন্যই তো অবন ঠাকুরের ‘ক্ষীরের পুতুল’ গল্পে মা ষষ্ঠীর কাছ থেকেই দুয়োরানিকে ছেলে এনে দিয়েছিল বানর। বহুদিন ধরেই সন্তানের ভাল থাকার কামনায় ষষ্ঠীর পুজো করে আসছেন বাংলার মায়েরা। কোনও মাসে অশোকষষ্ঠী রূপে, কোনও মাসে অরণ্যষষ্ঠী রূপে, কখনও আবার শীতলষষ্ঠী রূপে প্রচলিত ছিল দেবী ষষ্ঠীর ব্রতপালন। কিন্তু দিনে দিনে যেমন ব্রতের রূপ বদলায়, তেমন করেই একসময় বদলে যায় জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ল তিথির ষষ্ঠী পূজা। অরণ্যষষ্ঠীর বদলে জামাইষষ্ঠী পালন শুরু করল বাঙালি।
আরও শুনুন: রান্নাপুজো: বাংলার নিজস্ব এই সংস্কৃতির ধারা আজও বইছে ঘরে ঘরে
আজকের গ্লোবাল বাঙালি ‘ফাদারস ডে’, ‘মাদারস ডে’ পালন করে বটে। কিন্তু আগেকার দিনেও যে এমন বিশেষ দিবসের চল ছিল, ‘বাংলার ব্রত’ বইয়ে সে কথাই জানিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি জানিয়েছিলেন, কোনও মানুষকে একদিন বিশেষভাবে আদরযত্ন করার জন্য বাংলায় একাধিক ব্রতের প্রচলন ছিল। কোনও সধবা নারীকে শাড়ি সিঁদুর পান দিয়ে, পেটপুরে খাইয়ে ‘আদর-সিংহাসন’ ব্রত পালন করতেন বাংলার মেয়েরাই। আবার ‘ব্রাহ্মণাদর’ ব্রতে একইরকমভাবে আদর আপ্যায়ন করা হত কোনও ব্রাহ্মণকে। তা, মানুষ পুজোর চল যখন রয়েইছে, তখন জামাইকে আদরআত্তি করা হবে না, সে কি হতে পারে! বিশেষ করে কুলীন প্রথার বাড়বাড়ন্তে মেয়েসন্তানটি পরের ঘরে গিয়ে যাতে ভাল থাকে, তার জন্য জামাইকে তুষ্ট করতে প্রাণপণে চেষ্টা করতেন সেকালের বাঙালি গেরস্থরা। তাই জামাইকে তোয়াজ করার জন্যই চালু হল জামাইষষ্ঠীর। জামাইষষ্ঠীর ব্রতকথার একেবারে শেষ অংশে রয়েছে জামাইদের উল্লেখ। যেখানে বলা হয়েছে, জীবনে বহু কষ্ট যন্ত্রণা সহ্য করেছিল এক বউ। তারপর দেবী ষষ্ঠীর আশীর্বাদ পেল সে, দেবী তাকে জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ল ষষ্ঠীতে অরণ্যষষ্ঠী ব্রতের নিয়মকানুন শিখিয়ে দিলেন। সে এ দিনে মেয়ে-জামাইকেও নেমন্তন্ন করল, জামাইয়ের কপালে দইয়ের ফোঁটা দিয়ে আম-কাঁঠালের বাটা দিল। আর সেখানে থেকেই এল জামাইষষ্ঠীর ধারণা। ষষ্ঠীপূজার দিনটিই প্রশস্ত, কারণ বাঙালি পরিবারের বেঁধে বেঁধে থাকার অভ্যাসে পরের ছেলেটিও যে একান্ত আপন। তাই মেয়ের সঙ্গে জামাইয়েরও মঙ্গল কামনা করে, মা ষষ্ঠীর সুতো হাতে বেঁধে, কপালে মাঙ্গলিক ফোঁটা দিয়ে জামাইষষ্ঠীর আচার পালন করেন শাশুড়ি। এই দিনটি আদতে অরণ্যষষ্ঠী ছিল বলেই হয়তো, একাধিক গাছগাছড়া, পাতা, দূর্বাঘাস ও বিভিন্ন মরশুমি ফলের অনুষঙ্গ বয়ে এসেছে জামাইষষ্ঠীতেও।
অর্থাৎ হিসাবমতো দেখতে গেলে একটি লোকাচারই একসময় এই সামাজিক অনুষ্ঠানের মর্যাদা পেয়েছে। জামাইষষ্ঠী নিয়ে গল্পের অবশ্য শেষ নেই। এমনই এক গল্পে বলা হয়, নিজে মাছ চুরি করে খেয়ে পোষা বেড়ালের নামে দোষ চাপিয়েছিল এক বাড়ির বউ। বাহনের এমন অপমান দেখে মা ষষ্ঠী গেলেন বেজায় খেপে। একাধিকবার বউয়ের সন্তান চুরি করেন তিনি। অবশেষে বনে গিয়ে ষষ্ঠীর পুজো করে সন্তান ফিরে পায় সেই বউ। কিন্তু মুশকিল হল, এইসব কাণ্ডের জেরে শ্বশুরবাড়ি থেকে বউয়ের বাপের বাড়ি যাওয়াই বন্ধ হয়ে গেল। তখন জামাইষষ্ঠীর ছল করেই জামাই, সঙ্গে মেয়েকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন বউয়ের মা-বাবা। আবার কারও কারও মতে, সেকালে সন্তানজন্মের আগে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার উপায় ছিল না তার মা-বাবার। তাই এহেন উদ্যোগ, মেয়েকে দেখতে পাওয়া, আবার ষষ্ঠী দেবীর পূজা করে তার সন্তানজন্মের বরটুকুও চেয়ে নেওয়া।
এই হল জামাইষষ্ঠীর ইতিহাস। তবে এইসব পেরিয়ে, জামাইষষ্ঠী এখন অনেকটাই আদরের অনুষ্ঠান। শাশুড়িমা যেমন জামাইকে আপ্যায়নের আয়োজন করেন, তেমন জামাই-ও কি আর খালি হাতে শ্বশুরবাড়িতে যেতে পারে। তাই তো শুনি বাঙালির আইকন উত্তমকুমার গেয়ে ওঠেন, কী করে আসে জামাই, শ্বশুরবাড়ি খালি হাতে…
সব মিলিয়ে আজকের দিনে জামাইষষ্ঠী এক পারিবারিক মিলনোৎসব। এই ব্যস্ত সময়ে, যখন পরিজনদের সঙ্গে দেখা হওয়া দূর অস্ত, কথাটুকুই হয় না, তখন এই সম্মিলনের অবকাশ যদি প্রথার অছিলায় মেলে, তবে মন্দ কী!