ভারতবর্ষে ইসলাম আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এই হিন্দু রাজা। তাঁর পরাক্রমেই সাময়িকভাবে থমকে গিয়েছিল মহম্মদ ঘোরির জয়রথ। তিনি পৃথ্বীরাজ চৌহান। সম্প্রতি যাঁর জীবনকে বড় পর্দায় তুলে আনছেন অক্ষয় কুমার। সত্যিই কি পৃথ্বীরাজ ছিলেন ভারতের শেষ হিন্দু সম্রাট? পৃথ্বীরাজ চৌহান সম্পর্কে সম্প্রতি এই দাবি উঠেছে। কিন্তু ইতিহাস কী বলে তাঁর সম্পর্কে? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
পৃথ্বীরাজ, অর্থাৎ পৃথিবীর রাজা। পৃথিবী না হোক, ভারতবর্ষের এক বড় এলাকা জুড়ে নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন পৃথ্বীরাজ চৌহান। কেউ কেউ বলে থাকেন, তিনিই নাকি ভারতবর্ষের শেষ হিন্দু শাসক। এ দেশে মুসলিম হামলার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তাঁর পরাক্রমেই থমকে গিয়েছিল মুসলিম আক্রমণ, পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছিল অনুপ্রবেশকারীরা। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি সেই বিজয়। শোনা যায়, দেশীয় রাজাদের বিশ্বাসঘাতকতার দরুনই নাকি শেষমেশ হেরে গিয়েছিলেন পৃথ্বীরাজ চৌহান। যুদ্ধক্ষেত্রেই বীরের মৃত্যু বরণ করেছিলেন তিনি। আর তাঁর পতনের ফলেই নাকি ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন সূচনার পথ প্রশস্ত হয়েছিল।
আরও শুনুন: শাহজাহান একা নন, ‘তাজমহল’ বানিয়েছিলেন আরও অনেকেই! কোথায় কোথায় রয়েছে সেগুলি?
হ্যাঁ, পৃথ্বীরাজ চৌহান সম্পর্কে এমন নানা কথাই শোনা যায়। ইদানীং কালে ফের চর্চায় উঠে এসেছে আটশো বছরের প্রাচীন এই রাজার কথা। ভারতে মুসলিম শাসনের পালটা হিন্দু শৌর্যের প্রতীক হিসেবেই দেখা হচ্ছে তাঁকে। তাঁর বীরত্বের কাহিনির উপরে ভিত্তি করে তৈরি ছবিও সম্প্রতি মুক্তি পেতে চলেছে রুপোলি পর্দায়। যদিও পৃথ্বীরাজ চৌহান সম্পর্কে ইতিহাসে খুব বেশি তথ্য মেলে না। এমনকি তাঁর বংশপরিচয় নিয়ে পর্যন্ত দ্বন্দ্ব রয়েছে। গুজ্জর এবং রাজপুত দুই সম্প্রদায়ই পৃথ্বীরাজকে নিজেদের বংশভুক্ত বলে দাবি করে। অক্ষয়কুমার অভিনীত ‘পৃথ্বীরাজ’ ছবির খবর ছড়িয়ে পড়তেই ফের সেই বিতর্ক উসকে উঠেছিল। এমনকি রাজপুত কর্ণী সেনার দাবিতেই ছবিটির নামের আগে ‘সম্রাট’ শব্দও জুড়তে হয়। কিন্তু আসলে কি সত্যিই শেষ হিন্দু সম্রাট ছিলেন পৃথ্বীরাজ চৌহান?
আসলে প্রাচীন রাজাবাদশাদের সম্পর্কে কোনও তথ্য জানা যায়, যদি সেই সময়ে কেউ তা সংরক্ষণ করে থাকেন। কিন্তু ইতিহাস সংরক্ষণের বিষয়ে প্রাচীন রাজারা অনেকেই তেমন গুরুত্ব দেননি। পৃথ্বীরাজের শাসনকাল সম্বন্ধে জানা যায় কেবলমাত্র তাঁর আমলে রচিত একটি বই, ‘পৃথ্বীরাজ রসো’ থেকে। কিন্তু পৃথ্বীরাজের বন্ধু এবং সভাকবি চাঁদ বরদই-এর লেখা এই কাব্যটি কতখানি আখ্যান, আর কতখানি ইতিহাস, তা নিয়ে রীতিমতো সংশয় রয়েছে। তবে ১৮১৭ সালে প্রকাশিত জেমস মিলের ‘দ্য হিস্ট্রি অফ ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ বইয়ে সময়ের হিসেবে পৃথ্বীরাজকেই ভারতের শেষ হিন্দু শাসক বলা হয়েছে। আবার ১৮২৯ সালে প্রকাশিত জেমস টড-এর বিখ্যাত বই ‘অ্যানালস অফ অ্যান্টিকুইটিস অফ রাজস্থান’-এও পৃথ্বীরাজকে ‘দ্য লাস্ট হিন্দু এম্পেরর’ বলা হয়েছে। যদিও আধুনিক ইতিহাসের সাক্ষ্য নিলে দেখা যায়, সেই যুগে ভারতে কোনও একজন শাসকের সার্বভৌম শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল না। ফলে কেবল একজন রাজাকে হারিয়ে গোটা ভারতবর্ষ দখল করে নেওয়াও কোনও মুসলিম শাসকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। এমনকি মুঘল আমলের শেষ প্রতাপশালী সম্রাট ঔরঙ্গজেবকেও দাক্ষিণাত্যে মারাঠাদের সঙ্গে ক্রমাগত লড়াই করে যেতে হয়েছে, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন হিন্দু রাজা শিবাজি। তবে পৃথ্বীরাজ ভারতের শেষ হিন্দু শাসক হোন বা না হোন, এ কথা ঐতিহাসিকভাবেই মান্যতা পেয়েছে যে, উত্তর-পশ্চিম ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলই নিজের অধিকারে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। রাজস্থান, দিল্লি, হরিয়ানা, পঞ্জাবের কিছু অংশ, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে তিনি সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন বলে শোনা যায়।
আরও শুনুন: কুতুব মিনার কি আদৌ দিল্লিতে ছিল! বিষ্ণুর সঙ্গেই বা কী যোগ এই স্তম্ভের?
আসলে সেকালের ভারতবর্ষে খণ্ড খণ্ড অঞ্চলে রাজত্ব চালাতেন এক-একজন শাসক। আর সে কারণেই বহিঃশত্রুর আক্রমণ সামলানো এ দেশের পক্ষে সহজ ছিল না। কিন্তু পৃথ্বীরাজ চৌহান এখানেই ব্যতিক্রম যে, অন্য কোনও রাজার সাহায্য না পেলেও তিনি একাই ভিনদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর শাসনকালে ভারতে হামলা চালান মহম্মদ ঘোরি। ১১৯১ সালে তরাইনের প্রথম যুদ্ধে মহম্মদ ঘোরিকে হারিয়ে দেন পৃথ্বীরাজ চৌহান। কিন্তু পরের বছর নয়া উদ্যমে ফের ভারতের উপর হামলা চালান ওই মুসলিম সম্রাট। এবার আর তাঁকে এঁটে ওঠা পৃথ্বীরাজের একার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ১১৯২ সালে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পরাজয় হয় তাঁর। আর এই পরাজয়ের ফলেই ভারতে মুসলমান শাসনের পথ খুলে যায় বলে মত ঐতিহাসিকদের। কারণ বিজিত অঞ্চলের ভার নিজের সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবক-এর উপর দিয়ে স্বদেশে ফিরে গিয়েছিলেন মহম্মদ ঘোরি। ১২০৬ সালে তাঁর মৃত্যুর পরেই নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করে ভারতের প্রথম মুসলিম সম্রাট হয়ে বসেন কুতুবউদ্দিন আইবক। আর এখান থেকেই ভারতে ইসলাম যুগের সূচনা হয়, যার শেষ হয় আরেক ভিনদেশি, ব্রিটিশের দখলে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে।
‘পৃথ্বীরাজ রসো’ কাব্যে পৃথ্বীরাজ চৌহানের হেরে যাওয়ার জন্য পড়শি রাজা জয়চাঁদের বিশ্বাসঘাতকতাকে দায়ী করেছিলেন কবি। আর সেই সূত্রে পৃথ্বীরাজের সঙ্গে জয়চাঁদের কন্যা সংযুক্তার প্রেমের এক রোমান্টিক উপাখ্যানও তিনি বুনে তুলেছিলেন। এমনকি তিনি এ কথাও লিখেছিলেন, যুদ্ধে আহত অবস্থায় বন্দি হয়েও আত্মসম্মান হারাননি পৃথ্বীরাজ। মহম্মদ ঘোরির চোখে চোখ রেখে কথা বলার অপরাধে তাঁকে অন্ধ করে দেওয়া হয়, এমনটাও দাবি করেছেন তিনি। অবশেষে এক প্রতিযোগিতার সুযোগে শব্দভেদী বাণ ছুঁড়ে মহম্মদ ঘোরিকে হত্যা করেন অন্ধ পৃথ্বীরাজ, এমনই বলা হয়েছে এ কাব্যের উপসংহারে। বাস্তবে এসব কথার কতটুকু সত্যি, আর কতটা কল্পনা, তার পাথুরে প্রমাণ মেলে না। পৃথ্বীরাজকে ভারতের শেষ হিন্দু শাসক বলে দাবি করা নিয়েও বিতর্ক চলতেই পারে। তবে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বীরাজকে হারিয়েই যে দিল্লির মসনদে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে কথায় বোধহয় দ্বিমত করা চলে না।