পঞ্চায়েত জ্বরেই আপাতত কাবু দর্শক। আহামরি বাজেট নয়, ভিএফএক্স-এর কারিকুরি নয়, বাজিমাত সহজ জীবনের সরল গল্পেই। আর সেই গল্পের প্রাণকেন্দ্রে আছেন ব্রিজভূষণ দুবে ওরফে প্রধানজি। রঘুবীর যাদবের মাপা অভিনয়ে শুধু চাপা হাসির রসদ নয়, দ্বিতীয় সিজনে প্রধানজি কিন্তু বেশ কিছু বার্তাও দিয়েছেন দর্শককে। খেয়াল করে দেখেছেন কি? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
‘পঞ্চায়েত’ ওয়েব সিরিজের প্রাণপুরুষ যদি কাউকে বলতে হয়, তবে তাঁরা হলেন, সচিবজি আর প্রধানজি। এ বলে আমায় দেখ, তো ও বলে তো আমায়। তো এই প্রধানজি, এমন একটা চরিত্র যে সেই প্রথম সিজন থেকেই দর্শককে মাতিয়ে রেখেছেন। দ্বিতীয় সিজনে এসেও তাঁর জনপ্রিয়তা এতটুকু কমেনি। হাসির মুহূর্ত তৈরি হয়েছে বটে, পাশাপাশি প্রধানজি যেন জানিয়ে দিয়েছেন তিনি কেবল হাসির পাত্র নয়। ছোট ছোট ঘটনাতেই তার প্রমাণ দিয়েছেন।
দ্বিতীয় সিজনে পাল্টেছে গল্পের মেজাজ। পাল্টেছেন পঞ্চায়েত প্রধান ব্রিজভূষণ দুবেও। সময় যেমন করে মানুষকে আরও পরিণত করে, তেমন ভাবেই পরিণত হয়েছেন তিনিও। আর সেই হয়ে ওঠাকে সুনিপুণ ভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন দক্ষ অভিনেতা রঘুবীর যাদব।
আরও শুনুন: একজন করেছেন তুলো বিক্রি, অন্যজন আচমকাই অভিনয়ে… এই দুজনের জাদুতে এখন বুঁদ দর্শক
পঞ্চায়েত প্রধানদের পদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষনের ব্যবস্থা করেছে সরকার। বাধ্য হয়েই স্ত্রী মঞ্জুকে ভোটে দাঁড় করান ব্রিজভূষণ। খাতায়-কলমে মঞ্জুদেবী প্রধান হলেও পঞ্চায়েতের সমস্ত দায়িত্ব পালন করেন ব্রিজভূষণই। টিপ সইটুকু দিয়ে দায়িত্বমুক্ত হন মঞ্জুদেবী। নারীর গন্ডি সংসারের সাত কাজেই বাঁধা, এই বিশ্বাস থেকেই প্রথম সিজনে যাত্রা শুরু করেছিলেন পঞ্চায়েত প্রধান। অথচ গ্রাম্য রাজনীতি বুঝতে যে তিনি কম যান না কোনও অংশেই, তা ব্রিজভূষণের পাশাপাশি দর্শকদেরও প্রতিপদে বোঝাতে বোঝাতে গিয়েছেন সাংসারিক কাজকর্মে পরিপাটি মঞ্জুদেবী। তবে তাই বলে পারষ্পরিক সম্মানের অভাব কোনওদিনই তাঁদের সম্পর্কে ছিল না। তাই সাধারণতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে জেলাশাসকের সামনে স্ত্রীকে ছোট হতে দেননি পঞ্চায়েত প্রধান। বরং জাতীয় সঙ্গীতের প্রায় প্রতিটা শব্দেরই ধুয়ো স্ত্রীকে ধরাতে ধরাতে গিয়েছেন ব্রিজভূষণ। তবে প্রথম মরসুমের থেকে শিক্ষা নিয়ে ‘পঞ্চায়েত টু’-তে স্ত্রীকে নিয়ে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়েছেন পঞ্চায়েত প্রধান। শহুরে পঞ্চায়েত সচিবের আধুনিক ভাবনা চিন্তার ছোঁয়া লেগেছে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও। না, জীবনাদর্শের দিক থেকে কোনওদিনই গোঁড়া নন ব্রিজভূষণ। তাই সেই বদলকে সহজেই গ্রহণ করতে পেরেছেন তিনি। আর সেই গুণই মানুষ হিসেবে অনেক বড় করে তুলেছে পঞ্চায়েত প্রধানকে।
গোটা গ্রামের অভিভাবক পঞ্চায়েত প্রধান। গ্রামের প্রতিটা ভালমন্দের দায়িত্ব তাঁরই কাঁধে। বাকি আর পাঁচটা বাবার মতোই মেয়ে রিঙ্কির জন্য সেরাটুকু ছিনিয়ে আনতে চান তিনিও। তাই প্রথম থেকেই মোটা টাকা পণ দিয়ে মেয়ের বিয়ে দিতে আপত্তি ব্রিজভূষণের। এমনকি পাত্রপক্ষের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েও তিনি যে ঋজু সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন, তা ফুলেরার মতো প্রত্যন্ত একটা গ্রামের মানুষ হিসেবে যথেষ্ট দৃঢ় এবং ছকভাঙা। মেয়ে রিঙ্কির জন্য স্নেহ আর চিন্তা যে দুটোই যে সহজাত, তা বোধহয় গল্পের প্রথম থেকেই জানান দিয়েছে পঞ্চায়েত প্রধানের রিংটোন।
তবে রিঙ্কির বাবা থেকে দ্বিতীয় মরসুমের শেষে গিয়ে তিনি যেভাবে গোটা গ্রামের বাবা হয়ে উঠেছেন, তার উল্লেখ না করলেই নয়। গ্রামের ভালোর জন্য তিনি হত্যে দিয়েছেন উদ্ধত বিধায়কের দরজায়, আবার প্রয়োজনে তাঁর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেও কসুর করেননি। অন্যদিকে, সন্তানশোকে বিহ্বল প্রহ্লাদের মাথা নিজের বুকে টেনে নিয়েছেন একজন পিতার মতোই। সব হারানো একটা মানুষের পরিবার হয়ে উঠেছেন আপন স্বকিয়তায়। আবার প্রয়োজনে পঞ্চায়েত সচিবের অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেও পিছপা হননি পঞ্চায়েত প্রধান।
আরও শুনুন: স্ট্রাগল করেই মিলেছে সাফল্য, এই বলি তারকাদের লড়াইয়ের গল্প হার মানায় সিনেমাকেও
পঞ্চায়েতপ্রধান উদার, দানী এবং অতিথিপরায়ণ, তার নমুনা আমরা গল্পের প্রতি পর্বেই প্রায় পেয়েছি। তাই কাউকেই মুখের উপর ফেরাতে পারেননা তিনি। যে কোনও পরিস্থিতিতে পজিটিভ থাকার ক্ষমতা সকলের থাকে না। আর সেই গুণটাও রয়েছে পঞ্চায়েত প্রধানেরও। তবে এ গল্পে সর্বোপরি তিনি একজন নির্ভেজাল বন্ধু। আর সেটাই তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ। তাই সচিবের মুখে আত্মীয়হীনতার কথা শুনে আঁতে লাগে তাঁর। সচিবের অপমানের বদলা নিতে বিধায়কের সঙ্গে পর্যন্ত লড়ে যান তিনি। আবার বাদানুবাদ সত্ত্বেও সচিবের ঘরে ঢুকে পড়া সাপটিকে তাড়াতে বুক চিতিয়ে চলে যান পঞ্চায়েত প্রধান। গোটা গল্প জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এমনই হাজারটা বন্ধুত্বের উদাহরণ, যা পঞ্চায়েত প্রধানকে ভালবাসতে বাধ্য করবে দর্শকদের।
আসলে ব্রিজভূষণ কোনও বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা চরিত্র নয়। বরং এমন একশোটা ব্রিজভূষণ ঘুরে বেড়ায় আমাদের আশপাশেই। আর সেটাই দর্শকের কাছে পঞ্চায়েত প্রধানকে করে তুলেছে আরও কাছের। যাকে পর্দায় দেখার জন্য পরবর্তী মরসুমের অপেক্ষায় অধীর ওটিটি দর্শক।