ওটিটি সফল গল্প মানেই থ্রিলার কিংবা অপরাধ জগতের কিসসা। তার বাইরেও বাণিজ্য সফল সিরিজ যে বানানো যায়, তা দেখিয়ে দিয়েছে ‘পঞ্চায়েত’। ইতিমধ্যে প্রথম সিজনের জনপ্রিয়তাকে ছাপিয়ে দর্শকমহলে সুপারহিট ‘পঞ্চায়েত টু’। গল্পের শেষে ছেড়ে গিয়েছে তৃতীয় সিজনের ইঙ্গিতও। দুর্দান্ত সব অভিনেতাদের ভিড়ে নজর কেড়েছেন প্রহ্লাদ চরিত্রে থাকা ফয়জল। স্ক্রিনটাইম পেয়েছেন সামান্য, কিন্তু তাতেই বিনোদ চরিত্রে ছক্কা হাঁকিয়েছেন অভিনেতা অশোক পাঠকও। অথচ এই দুই অভিনেতাই কিন্তু অভিনয়ে এসেছিলেন দৈবাৎই। তাঁদের সেই পথচলার গল্প, আসুন শুনে নিই।
এই গল্পের ইউএসপি-ই সারল্য। সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা তরুণের লাখ টাকা প্যাকেজের চাকরি ফসকে যাওয়ার পর কী থাকে হাতে? কুড়ি হাজারির ছোট্ট একটা চাকরি, একটা গঞ্জগ্রাম আর এক ব্যাগ হতাশা। সেই হতাশা-সফরে শামিল হয়ে যায় একটা পঞ্চায়েত অফিস, আর চার অসমবয়সীর বন্ধুত্ব। আর সেই বন্ধুত্বের কাঁধে ভর করেই একটা সিজন থেকে অন্য সিজনে পা রেখে ফেলেছে ‘পঞ্চায়েত’। ইতিমধ্যেই তুমুল আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে ‘পঞ্চায়েত টু’-কে ঘিরে।
কে বলে থ্রিলার বা অপরাধ জগতের গল্প ছাড়া ওটিটি-সফল ছবি বানানো সম্ভব নয়! সেই সব ধারনাকে একাই পাল্টে দিতে পারে সিরিজটি। কী আছে এই গল্পে? প্রত্যন্ত গ্রাম ফুলেরা। খুব বেশি হলে হাজার খানেক লোকের বাস সেখানে। গ্রামের প্রান্তে ছোট্ট একটা পাকাঘর, সেটাই গ্রামের পঞ্চায়েত। তাকে কেন্দ্র করেই ঘুরবে গল্পের চরিত্র। হাসবে, কাঁদবে এবং দ্বিতীয় সিজনের শেষে কাঁদাবেও। আর রয়েছে একগুচ্ছ দুর্দান্ত অভিনেতা। স্বল্প সময়ের স্ক্রিনটাইমেও যারা নিজেদের সেরাটুকু দেওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছেন অনবরত। তাঁদের অনেকেই ওটিটি-তে আমাদের চেনা মুখ।
আরও শুনুন: উপার্জন ছিল না চার বছর, খ্যাতির পরেও স্ট্রাগলের গল্প শোনালেন অভিনেতা মাধবন
তবু সকলের মধ্যেই আলাদা করে নিজের উপস্থিত বুঝিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। পঞ্চায়েত প্রধানের ভূমিকায় থাকা দক্ষ অভিনেতা রঘুবীর যাদব বা ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র জীতেন্দ্র কুমার যে ভাল, তা তো বলাই বাহুল্য। তবে এই সিরিজের মূল আকর্ষণ বোধহয় উপ পঞ্চায়েত প্রধান প্রহ্লাদ। প্রহ্লাদের ভূমিকায় থাকা ফয়জল মালিককে এর আগে অনুরাগ কাশ্যপের গ্যাং অব ওয়াসিপুর-সহ একাধিক ছবিতে দেখেছেন দর্শক। পঞ্চায়েতের প্রথম সিজন জুড়ে প্রহ্লাদ যেন একফালি কমিক রিলিফ। যাকে দেখে আরাম পান দর্শকেরা। তবে সেই প্রহ্লাদই যে দ্বিতীয় সিজন শেষে দর্শকদের গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠবেন, তা কে বা জানত। অনেকেই হয়তো জানেন না ফয়জল আদতে বলিউড সিনেমার জগতের এক নামকরা প্রযোজক। কঙ্গনা রানাউত থেকে রণদীপ হুডা, বহু তারকাকে নিয়েই ইতিমধ্যেই ছবি করেছেন ফয়জল। লখনউতে বি.কম পাশ করার পরে এমবিএ পড়ার জন্য মুম্বইতে পাঠিয়েছিলেন বাবা। কিন্তু পড়াশোনায় মন বসেনি তাঁর। সেখান থেকে অভিনয় জগতে পা রাখা দৈবাতই। অনুরাগ কাশ্যপের ‘গ্যাং অব ওয়াসিপুর’ ছবির শুটিং চলাকালীন এক চরিত্রাভিনেতা হঠাৎ পালিয়ে যান। পরিচালক সেই চরিত্রটি করে দিতে বলেন ফয়জলকে। অনেক বলার পরে রাজি হন ফয়জল। তবে প্রথম ছবিতেই চরিত্রটিকে দুর্দান্ত ভাবে উতরে দিয়েছিলেন ফয়জল। ততদিনে প্রযোজক হিসেবেও যথেষ্ট পরিচিত মুখ ফয়জল। নিজের একটি প্রযোজনা সংস্থাও রয়েছে তাঁর।
এই সিরিজটির জন্য নিজেকে অনেকটাই ভেঙেছেন ফয়জল। ‘পঞ্চায়েত টু’ যেভাবে শেষ হচ্ছে, সেই মোড়খানা দর্শকদের মতোই অপ্রত্যাশিত ছিল তাঁর কাছেও। স্ক্রিপ্ট পড়েই তাই লেখকদের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। এমন একটা আবেগপ্রবণ দৃশ্যের সঙ্গে সুবিচার করতে আদৌ পারবেন কিনা তা নিয়েও দুশ্চিন্তায় ছিলেন ফয়জল। তবে মেকআপ, প্রস্থেটিক সামলে ছবির শেষে তিনি যা ঘটিয়েছেন তা ম্যাজিক বললে কম বলা হয়। এ গল্পে প্রহ্লাদ শুধু উপপ্রধান নয়। সে একজন বন্ধু, একজন অভিভাবক এবং অসহায় এক পিতাও। যে হাতের ছেলের জন্য রুটি সেঁকতেন যত্নে, সে হাতে ছেলের মুখে আগুন দেওয়ার সময় তাঁর অভিব্যক্তি মানুষকে এনে দাঁড় করিয়ে দেয় এক অদ্ভূত অনিশ্চয়তার সামনে। এই সিজনের প্রাণই তাই প্রহ্লাদ তথা ফয়জল।
আরও শুনুন: স্ট্রাগল করেই মিলেছে সাফল্য, এই বলি তারকাদের লড়াইয়ের গল্প হার মানায় সিনেমাকেও
না, আরও একজনের কথা না বললেই নয়। দ্বিতীয় সিজনের সামান্য অংশ জুড়েই ছিলেন তিনি। তবে নজর কেড়েছেন সেটুকু সময়েও। পঞ্চায়েত টু-তে বিনোদের ভূমিকায় থাকা অশোক পাঠকের অভিনয় জগতে আসার গল্পটাও কিন্তু অবাক করার মতোই। বলিউড জুড়ে যেখানে বারবার নেপোটিজম বা স্বজনপোষণের অভিযোগ ওঠে, সেখানে কেরিয়ার তৈরি করার জন্য বড় কোনও দাদা বা গডফাদারকে পাশে পাননি অশোক। কাজের সূত্রে বিহার থেকে হরিয়ানায় চলে এসেছিল তাঁর পরিবার। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই সংসারের পাশে দাঁড়াতে তুলো বিক্রি করা শুরু করেন অশোক। সাইকেল চালিয়ে এখান থেকে ওখানে তুলো ফেরি করে বেড়াতেন। সেখান থেকেই বারো ক্লাস পেরিয়ে কলেজে পা। পাশাপাশি শুরু হয় থিয়েটারে অভিনয়। ইতিমধ্যেই ‘আ ডেথ ইন আ গঞ্জ’ থেকে শুরু করে ‘সাংহাই’, ‘সেক্রেড গেমস’-এর মতো একাধিক ছবি ও ওয়েব সিরিজে দেখা গিয়েছে অশোককে। প্রশংসাও পেয়েছে তাঁর অভিনয়। ‘পঞ্চায়েত’-এর দ্বিতীয় সিজনেও অল্প সময়েই নিজেকে প্রমাণ করে ছেড়েছেন অশোক।
আসলে শুধু তারকামণ্ডিত ছবি বা অ্যাকশনের ঘনঘটা ছাড়াও যে শুধুমাত্র গল্প আর চরিত্রদের জোরে দর্শকদের টেনে বসিয়ে রাখা যায় তা ফের একবার প্রমাণ করে দিয়েছে ‘পঞ্চায়েত’। আপাতত তার তৃতীয় মরসুমের জন্য়ই প্রহর গুনছেন ভক্তেরা। না, কোনও বড় তারকা নয়, ফয়জল বা অশোকদেরই সেখানে আবার দেখতে চান আপামর দর্শককূল।