নিজের ঘরদুয়ার, পাড়া প্রতিবেশী বা দেশ কোনওটাই ভুলে উঠতে পারেননি আজও। তাই ৭৫ বছর একটা দেশে কাটানোর পরেও আজও তাঁকে টানে যোজন দূরের একটা ঘর। সেই স্মৃতি আগলেই এত বছর ধরে বেঁচে ছিলেন পুণের এই বৃদ্ধা। বয়স পেরিয়েছে নব্বইয়ের কোঠা। সব হারিয়েও হারাতে পারেননি সেই ভিটের স্বপ্নটুকু। চোখ বোজার আগে শেষবারের মতো ফিরে যেতে চান সেই গলিটিতে। তবে সেই ইচ্ছাও যে পূরণ হবে কোনওদিন, তা কি স্বপ্নেও ভেবেছিলেন বৃদ্ধা। কিন্তু হল তা-ও। আসুন, শুনি তাঁর স্বপ্নপূরণের গল্প।
দেশভাগের স্মৃতি আরও অনেকের মতোই তাঁর তাঁর কাছেও আজও দগদগে। হাজার চেষ্টা করেও রাওয়ালপিন্ডির সেই ছোট্ট গলি, পাড়াপ্রতিবেশী কাউকেই ভুলে উঠতে পারেননি তিনি। অথচ সেই কোন ছোটবেলায় ছেড়ে এসেছিলেন সব।
না, ঠিক ছেড়ে আসেননি। তখনও ভারত-পাকিস্তান অবিভক্ত এক দেশ। গরমের ছুটিতে রাওয়ালপিন্ডি থেকে সোলানে এসেছিলেন পরিবারের সকলে মিলে। সেটা ১৯৪৭। ইতিমধ্যেই হয়ে গেল দেশভাগ। আর দেশে ফেরা হল না ১৫ বছরের ছোট্ট রীনা বর্মার। তার পর এ দেশটাই হয়ে উঠল বাসস্থান। পুনেতেই ঘর বেঁধে থাকতে শুরু করলেন রীনারা। কিন্তু রাওয়ালপিন্ডির সেই ছোট্ট ‘প্রেম গলি’, এক ফালি ঘর ভুলতে পারলেন না কোনওদিন। এ দেশের মাটিতে কাটিয়েছেন ৭৫টা বছর। তবু জন্মস্থানের স্মৃতি আজও মখমলের মতো মনে হয় ৯০ বছরের রীনার কাছে।
আরও শুনুন: তুঙ্গে মাতৃদুগ্ধের চাহিদা, প্রায় ১১৮ লিটার স্তনদুগ্ধ বিক্রি করে নজির মহিলার
বাবা ভারী যত্ন করে ছোট্ট একফালি বাড়ি বানিয়েছিলেন। সেই বাড়ির একেকটা ইটে, সুরকিতে লেগেছিল বাবার পরিশ্রমের উপার্জন আর ভালবাসা। তা কি ভুলতে চাইলেও ভোলা যায়। পাড়ার সকলে আদর করে তাঁকে ডাকতেন তোশি নামে। আজও কানের ভিতর সেই ডাক শুনতে পান বৃদ্ধা। সমস্ত স্মৃতি জড়ো করে আজও বসেন বৃদ্ধা। সেসব নেড়েচেড়ে দেখেন। একদিন একটা সাদাকালো ধুলো মাখা ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করে ফেলেছিলেন বৃদ্ধা। সেই ছবি মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে। হাত ঘুরতে ঘুরতে তা চোখে পড়ে সজ্জনভাই নামে রাওয়ালপিন্ডির এক বাসিন্দার।
বৃদ্ধার গল্প শুনে নিজেই সেই বাড়ি খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছিলেন পাকিস্তানের বাসিন্দা সজ্জন। খুঁজেও পেয়ে যান বৃদ্ধার স্বপ্নের সেই ঘর। সেসবের ছবি, ভিডিও তুলে বৃদ্ধাকে পাঠান তিনি। আর সেসব এতদিন পরে চোখের সামনে দেখে আর স্থির থাকতে পারেননি বৃদ্ধা। একবার নিজে চাক্ষুষ করতে চান সেই গলি, সেই ঘরদুয়ার।
মেয়ে সোনালি থাকেন গুরুগ্রামে। একবার তাঁর কাছেই সেই ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন বৃদ্ধা। আর হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি সোনালি। মায়ের জন্য ভিসার আবেদন করে দিয়েছিলেন চটপট। কিন্তু বাতিল হয়ে যায় সেই আবেদন। তবে হাল ছাড়েননি মা-মেয়ে। পাকিস্তানি এক সাংবাদিকের পরামর্শে একটি ভিডিও বানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন রীনা। আর তা চোখে পড়েন পাকিস্তানের বিদেশ প্রতিমন্ত্রী হিনা রব্বানি খেরের।
আর তার তৎপরতাতেই রীনার জন্য নব্বই দিনের ভিসা মঞ্জুর করেছে পাক সরকার। অবশেষে নিজের জন্মভূমিতে ফিরতে চলেছেন নব্বই বছরের ভিসা। আগামী জুলাইতেই পাকিস্তানের উদ্দেশে রওনা হবেন রীনা। আর এ কথা যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করাতে পারছেন না বৃদ্ধা। সেই ঘর, সেই পাড়া। আজ ওই বাড়িতে কারা থাকেন তা জানেনও না বৃদ্ধা। আদৌ কি তাঁরা বাড়িতে ঢুকতে দেবেন তাঁকে! এমনই হাজার রকম চিন্তাভাবনা সাঁতার কাটছে তাঁর মাথায় দিনভর।
আরও শুনুন: জল যেন অ্যাসিডের মতো! খাওয়া তো দূর, কাঁদতে পর্যন্ত পারে না কিশোরী
রাওলপিন্ডির সেই ‘প্রেম গলি’, যেখানে থাকতেন রীনারা,সেখানে বেশির ভাগ মানুষই মুসলিম। তাতে কি! এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে বেড়াতেন ছোট্ট তোশী। সবাই তাঁকে ভালবাসত। আদর করে এটা-ওটা খাওয়াত। তাঁদের ধর্মটা যে ভিন্ন, তা আলাদা করে কোনও দিনও বুঝতেই পারেননি। আজকে কান পাতলেই ধর্মীয় হানাহানি, বিদ্বেষ। এসব যেন বুঝে উঠতে পারেন না নবতিপর বৃদ্ধা।
শুধু রীনাই নন, তার মা-ও কোনওদিন ভুলে উঠতে পারেননি রাওয়ালপিন্ডির ঘরদুয়ার। নিজের ভিটে দেখে মরার ইচ্ছা পূরণ হয়নি তাঁর। বাবা-মার সেই স্বপ্ন বুকে নিয়ে বেঁচে রয়েছেন রীনা। হারিয়েছেন স্বামীকে। কিছুদিন আগে মারা গিয়েছেন রীনার বড় ছেলেও। তবু নিজের জন্মভূমিকে শেষবার ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন ছাড়তে পারেননি রীনা। এই বয়সে একা একা পাকিস্তানে যেতেও অকুতভয় বৃদ্ধা। জানালেন, তাঁর মধ্যে সবসময়ে একখণ্ড রাওলাপিন্ডি বেঁচে ছিল। আর সেটার টানেই একবার অন্তত নিজের দেশে ফিরতে চান বৃদ্ধা।