ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে অস্ত্রশস্ত্র জোগার করে বেরিয়ে পড়েন তাঁরা। কারওর হাতে তীর-ধনুক তো কারও হাতে লাঠি-সোঁটা, বল্লম। কোমরে আঁচল শক্ত করে পেঁচিয়ে গোটা জঙ্গলটা টহল দেন তাঁরা। বাঘ-ভাল্লুকের মতো বন্যপ্রাণীদের থেকে ওদের ভয় নেই। বরং ভয় বেশি মানুষের থেকেই। অবৈধ পাচার, চোরাচালান রুখতে তাই সদা সক্রিয় ঝাড়খন্ডের এই প্রমীলা বাহিনী। আসুন, শুনে নিই ওদের কথা।
জঙ্গলের সীমান্ত ঘেঁষেই ওদের ঘর। জীবন-জীবিকা সব কিছুর জন্যই নির্ভর করতে হয় ওই জঙ্গলের উপরেই। না, বন্যপ্রাণীদের থেকে ভয় নেই ওঁদের তেমন। বরং ভয় মানুষের থেকেই। মানুষের লোভের হাত থেকে জঙ্গলকে বাঁচাতে তাই সকলে মিলে উঠেপড়ে লেগেছেন।
ঝাড়খণ্ডের সরকাঘাট গ্রামের একদল আদিবাসী মহিলা। বনসম্পদকে বাঁচাতে সেই ২০১১ সাল থেকে লড়াই করে যাচ্ছেন তাঁরা। ভোরের আলো না ফুটতেই ঘর ছাড়েন। লাঠি, সড়কি, তির-ধনুক হাতে বেরিয়ে পড়েন জঙ্গলের উদ্দেশে। না, শিকার করতে নয়। বরং শিকারি, চোরাচালানকারীদের হাত থেকে জঙ্গলকে বাঁচানোই ওদের লক্ষ।
জামশেদপুর পুলিশের হোম গার্ড কান্দোনি সোরেন, গোটা পরিকল্পনার মূলে রয়েছেন তিনিই। তাঁরই উদ্যোগে শুরু হয়েছিল এই বনরক্ষা বাহিনীর। না, তখনও অবশ্য পুলিশে চাকরি পাননি কান্দোনি। ২০১৮ সালে পুলিশের কাজে যোগ দেন। তবে দোষীদের পাকড়াও করার কাজটা তিনি করে চলেছেন অনেক আগে থেকেই। শুধু সরকাঘাট বলেই নয়, আড়াইশো একরের জঙ্গলের ধার ঘেঁষে রয়েছে আরও বেশ কয়েকটি গ্রাম। সেসব গ্রামের আদিবাসী মহিলাদের জড়ো করে এই কর্মসূচী শুরু করেছিলেন কান্দোনি।
আরও শুনুন: ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে সবুজের অভিযানে! আস্ত শহরকে গাছপালায় সাজিয়ে তুলেছেন লতিকা
মূলত জঙ্গল থেকে কাঠ কুড়িয়েই জীবন নির্বাহ করতেন এইসব আদিবাসী মহিলারা। কিন্তু অনেক সময়েই দেখা যায় যে বাইরে থেকে লোকেরা ঢুকে জঙ্গলের গাছ কেটে পালাচ্ছে। শুধু কাঠই নয়, চুরি যাচ্ছে ফলমূল, আনাজ থেকে শুরু করে অনেক কিছুই। তার উপর রয়েছে জঙ্গলমাফিয়া এবং চোরাচালানকারীরা। অনেকেই জঙ্গলকে ঘাঁটি বানাচ্ছে নানা সমাজবিরোধী কার্যকলাপের জন্য। প্রাথমিক ভাবে সেসব আটকাতেই তৈরি হয়েছিল এই প্রমিলাবাহিনী। এ কাজে তাঁদের সাহায্য করেছে বনদপ্তর ও স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত। ইতিমধ্যেই জঙ্গলের বেশ কিছু বেআইনি কার্যকলাপ রুখে দিতে সফল হয়েছেন তাঁরা।
তবে শুরুটা হয়েছিল মাত্র পাঁচ জন মহিলাকে নিয়ে। কান্দোনি দলের নাম রাখলেন’হরিয়ালি সাকম’। যার বাংলা করলে দাঁড়ায় সবুজ পাতা। এই সবুজ পাতার সেনানীরা গত এগারো বছর ধরে নিয়মিত পাহাড়া দিয়ে চলেছেন জঙ্গলকে। একদিনও এ কাজে ভুলচুক হয়নি। সত্যি সত্যিই কি প্রমীলা বাহিনীকে দেখে ভয় পায় জঙ্গলমাফিয়ারা। কান্দোনির কথায়, প্রথম প্রথম ভয় না পেলেও তাঁদের উপস্থিতি অস্বস্তি দিত দুষ্কৃতীদের। ক্রমশ সবুজ দল বুঝতে পারল নজরদারির সুফল মিলছে। বেশ কিছু দুষ্কৃতীকে তো ধরে স্থানীয় প্রশাসনের হাতে তুলেও দিয়েছেন তাঁরা। ক্রমশ ছোট থেকে বড় হয়েছে সবুজ দল। এখন সেখানে কম করে হলেও রয়েছে ৪০ জন কর্মী। জঙ্গলের নিরাপত্তার দিকে যাঁরা নজর রেখে চলেছেন প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই। বিভিন্ন সময়ে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে জঙ্গল পাহারা দেন তাঁরা। নিরাপত্তার প্রয়োজনে কাঁধে তুলে নিয়েছেন অস্ত্রও।
আরও শুনুন: বৃক্ষরোপণ নেশা, ৪০ বছরে ১১ লক্ষেরও বেশি গাছ লাগিয়ে নজির জয়রামের
তাঁদের উদ্যোগ দেখে অনুপ্রাণীত হয়েছেন গ্রামের মানুষও। তাঁরাও নিজেদের মতো করে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। কোথাও বেআইনি কিছু দেখলেই খবর যায় সবুজ দলের কাছে। এর জন্য রয়েছে আলাদা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপও। সবুজ দলের তৎপরতায় ইতিমধ্যেই জঙ্গলে সমাজবিরোধী কাজকর্ম কমানো গিয়েছে। বেআইনি ভাবে গাছ কাটা একেবারে বন্ধ না করা গেলেও তা ৮০-৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো গিয়েছে বলে জানিয়েছে কান্দোনি নিজেই। সারাদিনের থানার কাজ সামলে জঙ্গলপ্রহরার কাজে হাজির হয়ে যান তিনি। এ নিয়মের কোনও দিনও অন্যথা হয়নি। জঙ্গল বাঁচাকে যে সাহসী ভূমিকা নিয়েছেন কান্দোনি, তার জন্য সহকর্মীরা তাঁকে ডাকেন শেরনি নামে। জামশেদপুর থানায় ওটাই এখন পরিচয় তাঁর। আর সেই শেরনির নেতৃত্বেই ক্রমশ বৃক্ষ হয়ে উঠছে তাঁর সবুজপাতা বাহিনী।