যুদ্ধ মানেই গুলি, গোলা-বারুদ। কিন্তু যুদ্ধ মানে উল-কাঁটা কিংবা সেলাই-ফোঁড়াই, এমনটা শুনেছেন কখনও। না, কাঁটা দিয়ে রক্তারক্তি, মারামারি এমন কিছু কিন্তু নয় মোটেই। বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধের অন্যরকম হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল বয়নকাজই। কীভাবে? আসুন, শুনে নিই।
ট্রেনের জানলার ধারে বসে মনোযোগ দিয়ে উল বুনে চলছেন এক মহিলা। এ দৃশ্য খুবই সাধারণ। এই অতি সাধারণ ঘটনার মধ্যে দিয়েই যে কত কিছু হয়ে যেতে পারত, তা কল্পনা করা ছিল বেশ মুশকিল। হাতে বোনা সেই উলের কারুকার্যই ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিত শত্রুপক্ষের ব্যাপারে খুঁটিনাটি খবর। যে উল কাঁটা বুনে দেয় শীতের মখমলে সোয়েটার তা কী করে হয়ে উঠল যুদ্ধের হাতিয়ার, সেই গল্প কিন্তু অবাক করার মতোই।
আরও শুনুন: প্রথমে ছিলেন বেঁটে, পরে বেজায় লম্বা… অদ্ভুত রূপান্তরে বিশ্ববাসীকে অবাক করেছিলেন এই ব্যক্তি
সেটা অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কথা। সৈনিকদের সাহায্য করতে বাড়ির মহিলারা জামা-মোজা এসব বানিয়ে সরবরাহ করতেন হামেশাই। তবে এর বাইরেও দরকারি ছিল উল-কাঁটা-সেলাই। কারণ এ সবের সহায়তাতেই সেসময় গুপ্তচর হিসেবে কাজ করতেন বহু মহিলাই। উল-কাঁটা বুনে বুনে তার মাধ্যমেই চলত খবর পাচার।
কী ভাবে? ব্যাপারটা ছিল অনেকটাই স্টেনোগ্রাফির মতো। স্টেনোগ্রাফি বা শর্ট হ্যান্ড শিখতে গেলে যেরকম কিছু সংকেত শেখার দরকার হয়, উল-কাঁটা দিয়ে তেমনই কিছু নকশা তুলতেন গুপ্তচরেরা। যা খালি চোখে দেখলে তো মনে হত সাধারণ উলের বোনা একটা রুমাল বা চাদর। তবে ওই নকশার মধ্যেই লুকানো থাকত গোপন খবরমালা। শত্রুপক্ষের লোকেরা যা আন্দাজও করতে পারতেন না। সে সময় শুধু মহিলারাই নয়, বন্দি থেকে শুরু করে হাসপাতালের রোগী এমনরি বাচ্চাদেরও শেখানো হল উল বোনা। যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈনিকদেরও দেওয়া হল উল বোনার বিশেষ প্রশিক্ষণ।
তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই সেলাই ও উল বোনাই হয়ে উঠেছিল গুপ্তচরবৃত্তির প্রধান অস্ত্র। অনেক সময়ই কাপড়ের মধ্যে গোপন খবর রেখে তা সেলাই করে দেওয়া হত এমন ভাবে যা দেখে কারওর সন্দেহ পর্যন্ত হবে না। তারপর সেই কাপড় দিয়েই তৈরি করে দেওয়া হত হোসিয়ারি দ্রব্য।
মার্কিন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে এমনই এক গুপ্তচরের কথা জানা যায়। ব্রিটিশ সেনা তখন একের পর এক বাড়িঘরের দখল নিচ্ছে, সেগুলোকে বানিয়ে তুলছে সেনাঘাঁটি। ফিলাডেলফিয়ার বাসিন্দা মলি মম রিঙ্কার নামে এক বাসিন্দার বাড়িতে একদিন এমনি করেই ঢুকে পড়েছিল ইংরেজ সেনা। বাড়ির সমস্ত পুরুষকে টেনে হিঁচরে বের করে দেওয়া হয় বাইরে। শুধু থেকে যান মলি। এমনি এমনি নয়, সেনাদের যত্নআত্তির জন্য আটকে রাখা হয়েছিল তাঁকে। স্বাভাবিক ভাবেই ইংরেজ সেনাদের কথাবার্তা কাছ থেকে শুনতে পেতেন তিনি। আর সেসব খবর তিনি পাচার করতেন বাইরে। একটা কাগজে সেসব গুছিয়ে লিখে সেটা দিয়ে মুড়ে ফেলতেন একটা পাথর। তার ওপর উল জড়িয়ে জড়িয়ে তৈরি করতেন একটা গোলা। বাইরে থেকে দেখলে সেটাকে উলের গোলা মনে হলেও তার মধ্যে লুকানো থাকত গোপন সেসব খবরাখবর।
গুপ্তচরবৃত্তির জন্য় উল ব্যবহার করার রীতি ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়েও। ম্যাডাম লাভেঙ্গেল নামে এক ফরাসি মহিলা নাকি জানলার ধারে বসে দিনরাত উল বুনে চলতেন। আর তারই ফাঁকে নজর রাখতেন জার্মান সেনার কার্যকলাপের উপরে। আর সে সমস্ত তথ্য পা মেঝেতে ঠুকে ঠুকে বিশেষ কোডের মাধ্যমে পৌঁছে দিতেন নিচের তলায় থাকা ছেলেমেয়েদের কাছে। তারাও পড়াশোনার ভান করতে করতে সে সব নথিবদ্ধ করে ফেলত খাতায়। জার্মান সেনা কোনও দিন তার আঁচও পায়নি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এলিজাবেথ বেন্টলে নামে এক মার্কিন গুপ্তচর একই ভাবে খবর পাচার করতেন। শুধু তাই নয়, দু-দুটি গুপ্তচর সংস্থাও চালাতেন তিনি। সোভিয়েত ইউনিয়নের খবর উলের জিনিসের মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খ পৌঁছে দিতেন আমেরিকার কাছে। সে সময় নাকি এই কাজের জন্য রীতিমতো মহিলাদের নিযুক্ত করা হত বেলজিয়ামে। তাঁদের কাজই ছিল রেলগাড়ির কামরায় বসে উল বোনা। আর তার ফাঁকেই জার্মানদের রেল সংক্রান্ত কার্যকলাপের তথ্য ওই উলের নকশায় নথিবদ্ধ করে নিতেন তাঁরা।
আরও শুনুন: পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুধার্ত মানুষ নাকি ইনি! রাক্ষুসে খিদের কারণেই হয়েছিলেন গুপ্তচরও
ফলে যুদ্ধে এই উল বোনার ভূমিকাটা কতখানি ছিল তা তো বোঝাই যাচ্ছে। ইদানীং কেনা সোয়েটারেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে মানুষ। তাই উল-কাঁটা উঠেছে গিয়ে সিন্দুকে। তবে কেউ কেউ অবশ্য এখনও শখের বশে উলকাঁটায় নকশা তোলেন। প্রিয় মানুষের জন্য বুনে ফেলেন সোয়েটার-মাফলার। তবে এমন মানুষজন দেখতে পেলে কিন্তু খুব সাবধান। রেলগাড়ির কামরায় বসে উল-কাঁটা নিয়ে একমনে বুনে চলেছেন যিনি, তিনি যে ভয়ঙ্কর কোনও গুপ্তচর নন- এসব গল্প শোনার পর তা ভাবাটা বোধহয় আর সহজ হবে না।