সংসারের চৌহদ্দিতে আবদ্ধ যাঁরা, তাঁদের বাইরের বিশ্ব দেখার চোখ আবার তৈরি হয় নাকি! সিনেমায় অভিনয় তা-ও মানা যায়। তাই বলে চলচ্চিত্র পরিচালনা করবেন একজন মহিলা। যেখানে সিনেমার রংমহলে মহিলাদের প্রবেশই ছিল সেসময় নিষিদ্ধ, সেখানে সমস্ত ধারনার সমূলে গিয়ে আঘাত হেনেছিলেন তিনি। তিনি ফতিমা বেগম। ভারতীয় সিনেমার প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা। কর্মজীবনের মতো স্পর্ধাময় তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও। আসুন, শুনি তাঁর কথা।
এক সময় এই দুনিয়াটায় মেয়েদের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। এমনকি নারী চরিত্রেও মেয়ে সেজে অভিনয় করতেন পুরুষেরাই। একটা সময় সেই জায়গাটা ভাঙতে চলচ্চিত্রে জায়গা দেওয়া হল বারবণিতাদের। সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েদের তখনও সেখানে আসা গুরুতর অপরাধ। অন্য দিকে, সিনেমার জগতের মেয়ে মানেই পতিতাপল্লীর বাসিন্দা, এমন একটা বদ্ধমূল ধারণা গেঁথে দেওয়া হল সমাজের মাথায়। ফলে সেই অন্ধকার কাটতে সময় কম লাগেনি। তবু একদিন ভারতীয় সিনেমায় জায়গা করে নিলেন মেয়েরা। ভাঙতে লাগলেন ট্যাবু।
ট্যাবু তো ভাঙল। কিন্তু তাই বলে পরিচালনার দায়িত্ব সামলাবে মেয়েরা। মেয়েরা ঘর সামলাতে পারেন, সংসার আগলাতে পারেন। তাই বলে গোটা একটা সিনেমার কর্মযজ্ঞ। তবু সেই ধারণার সমূলে আঘাত করলেন কেউ কেউ। আর তার দেখানো পথেই বিংশ শতাব্দী পেল একের পর এক নাম। অপর্না সেন থেকে শুরু করে মীরা নায়ার বা নন্দিতা দাশ, ফারহা খান থেকে শুরু করে জোয়া আখতার বা মেঘনা গুলজার। কিন্তু প্রথম দরজাটা খুলে গিয়েছিল যাঁর হাত ধরে, তিনি ফতিমা বেগম।
আরও শুনুন: ক্যামেরায় চোখ রাখলেই ম্যাজিক! সিনেমাটোগ্রাফির দুনিয়ায় বদল এনেছিলেন বিজয়লক্ষ্মী
১৮৯২ সালে এক মুসলিম পরিবারে জন্ম ফতিমার। ছোট থেকেই তৈরি হয়েছিল উর্দু নাটকে অভিনয়ের অভ্যাস। ১৯২২ সালে তিরিশ বছর বয়সে প্রথম সিনেমায় পা দেন ফতিমা। আরদেশির ইরানি পরিচালিত ‘বীর অভিমন্যু’ নামে সেই ছবিটি অবশ্য ছিল একটি নির্বাক সিনেমা। ততদিনে তিনি উর্দু নাটকের মঞ্চের বেশ বড় নাম। তবে সিনেমায় তখনও মেয়েদের মুখ দেখানোটাই ছিল যথেষ্ট বড় চ্যালেঞ্জ। বাকি সব কিছু অনেক দূরের কথা।
তবু লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন ফতিমা। ১৯২৪ সালে প্রায় একইসঙ্গে ফতিমা অভিনীত চারটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল। আর এক ধাপ এগিয়ে ১৯২৬ সালে নিজের একটি প্রযোজনা সংস্থা খুললেন তিনি। সম্ভবত সেখানেও ছিলেন তিনিই প্রথম।
‘ফতিমা ফ্লিমস’ দিয়ে শুরু করলেও ১৯২৮ সালে প্রযোজনা সংস্থার নাম বদলে রাখলেন ‘ভিক্টোরিয়া-ফতিমা ফিল্মস’। ছোট থেকেই চিত্রনাট্য লেখার শখ ছিল তাঁর। তাঁর লিখিত চিত্রনাট্য এর আগেও সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছে। তবে এ বার নিজের জন্য কলম ধরলেন ফতিমা। নিজের প্রযোজনা সংস্থা থেকে ‘বুলবুল-এ-পরিস্থান’ নামে একটি ছবি বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। একটি পার্সি রূপকথার উপর নির্মিত সেই সিনেমার বাজেট সেসময় বেশ বেশি ছিল। ফ্যান্টাসি সিনেমা হিসেবে বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছিল ছবিটি। তবে দুর্ভাগ্যবশত এই ছবিটির আজ আর একটিও প্রিন্ট পাওয়া যায় না। ফলে কেমন ছিল ভারতীয় সিনেমার প্রথম নারী নির্দেশকের কাজ, তা সচক্ষে দেখার আজ আর কোনও উপায় নেই।
তবে এর পরেও একাধিক ছবি বানিয়েছেন ফতিমা। সেসব সিনেমার বেশিরভাগ জুড়েই থাকত নারীচরিত্ররা। ‘হীর-রাঞ্ঝা’, ‘চন্দ্রবলী’ বা ‘গডেস অব লাভ’-এর মতো বেশ কিছু সিনেমা উপহার দিয়েছিলেন ফতিমা। নিজের তিন মেয়েকে নিয়েও ছবি বানিয়েছিলেন তিনি। ১৯২৯ সালে ‘গডেস অব লাভ’-এর পর অবশ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ সরে আসেন ফতিমা। তাঁর মেয়ে জুবেদা ছিলেন ভারতের প্রথম সবাক চলচ্চিত্রের নায়িকা। ঘটনাক্রমে ‘আলম আরা’ নামে সেই ছবিটিও পরিচালনা করেছিলেন আরদেশির ইরানি। ছবি পরিচালনা থেকে সরে এলেও অভিনয় থামাননি ফতিমা। কহিনুর স্টুডিও ও ইমপেরিয়াল স্টুডিওর হয়ে একাধিক ছবিতে অভিনয় চালিয়ে গিয়েছেন তিনি।
আরও শুনুন: ছক ভেঙেছিলেন উমাদেবী, তিনিই ভারতীয় সিনেমার প্রথম মহিলা কমেডিয়ান
তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও কম রোমাঞ্চকর নয়। শোনা যায়, সচিন রাজ্যের তৃতীয় নবাব সিদি ইব্রাহিমকে বিয়ে করেছিলেন ফতিমা। তবে সেই বিয়ের কোনও প্রমাণ নেই। এ-ও শোনা যায়, নবাবের সঙ্গে কোনও এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন ফতিমা। ভবিষ্যতে জুবেদা, সুলতানা ও শেহজাদিকেও নিজের মেয়ে বলে স্বীকৃতি দেননি নবাব। তবে ব্যক্তিগত জীবন যেমনই হোক না কেন, কর্মক্ষেত্রে দাপটের সঙ্গে কাজ করেছেন এই প্রতিভাময়ী শিল্পী। ১৯৮৩ সালে ৯১ বছর বয়সে মৃত্যু হয় বলিউডের এই নক্ষত্রের। শুধু অভিনয় নয়, চলচ্চিত্রনির্মাতা থেকে চিত্রনাট্যকার- পুরুষপ্রাধান্যময় প্রায় প্রত্যেকটা জায়গাতেই নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন ফতিমা বেগম। ভেঙেছিলেন সমস্ত সংস্কারের বেড়াজাল। ব্যাক্তিগত জীবন ও কর্মক্ষেত্র, দুই জায়গাতেই হয়ে উঠেছিলেন ব্যতিক্রমী।