বক্ষ বা স্তন স্পর্শ করে নাবালিকা হেনস্তার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী রায় কলকাতা হাই কোর্টের। সম্প্রতি একটি মামলার নিরিখে উচ্চ আদালত সাফ জানাল, স্তন পূর্ণ বিকশিত হয়েছে কি-না তা এক্ষেত্রে বিবেচ্য নয়। যদি না-ও হয়, তা সত্ত্বেও নাবালিকার বক্ষ স্পর্শ করাই যৌন হেনস্তা-ই। ঠিক কোন প্রেক্ষিতে এই রায় আদালতের? আসুন শুনে নিই।
ত্বক স্পর্শ না করলে অর্থাৎ ‘স্কিন-টু-স্কিন কনট্যাক্ট’ না হলে নাবালিকার বক্ষস্পর্শ যৌন অপরাধ নয়। কিছুদিন আগে বম্বে হাই কোর্টের এই রায় নিয়ে ঝড় উঠেছিল বিতর্কের। সেক্ষেত্রেও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে এক নাবালিকার স্তন স্পর্শ করার অভিযোগ উঠেছিল। যদিও ওই রায়ে আদালত জানিয়েছিল, যেহেতু অভিযুক্ত নাবালিকার পোশাক খুলে বক্ষ স্পর্শ করেনি, তাই এই ঘটনাকে নারীর সম্মানহানিজনিত অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করা সম্ভব হচ্ছে না। এহেন রায় নাবালিকা হেনস্তায় সুবিচার পাওয়ার পথকে যেন পিছিয়ে দিয়েছিল কয়েক কদম। এমনই মত প্রকাশ করেছিল নাগরিক সমাজের বৃহত্তর অংশ। এবার ঠিক একই রকম ঘটনার নিরিখে যুগান্তকারী রায় দিল কলকাতা হাই কোর্ট। সাফ জানিয়ে দেওয়া হল, নাবালিকার স্তন পূর্ণ বিকশিত কি-না, তা বিবেচ্য নয়। বক্ষ স্পর্শ করাই যৌন হেনস্তা।
আরও শুনুন: জখম হয়েও বাঁচালেন অন্যের প্রাণ, গুলিবৃষ্টির মধ্যে অন্তঃসত্ত্বার ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন যুবক
ঘটনাটি ২০১৭ সালের। জনৈক রোহিত পালের বিরুদ্ধে এক নাবালিকাকে যৌন হেনস্তার অভিযোগ ওঠে। নাবালিকার মায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে জানা যায়, অভিযুক্ত যখন বাড়িতে ঢুকেছিল তখন নাবালিকা একাই ছিল। সুযোগ বুঝেই সে ঘরে ঢুকেছিল। নাবালিকার হাত ধরে নিজের দিকে জোর করে টেনে আনে এবং তার স্তন স্পর্শ করে। নাবালিকার শরীরের বিভিন্ন অংশে আপত্তিকর ভাবে স্পর্শ করার অভিযোগও ওঠে। এমনকী অভিযুক্ত নাবালিকার গালে জোর করে চুমু খেয়েছিল বলেও জানা যায়। মেয়েটি ভয়ে চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করলে অভিযুক্ত চম্পট দেয়। ট্রায়াল কোর্টে অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয় অভিযুক্ত।
আরও শুনুন: ইউক্রেনে আতঙ্কের অন্য রূপ! অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ছেন রুশ সেনার হাতে বন্দি মহিলারা
অপরাধ থেকে বাঁচতে একটি যুক্তিও খাড়া করে সে। আদালতকে জানানো হয়, যেহেতু মেয়েটির বয়স ১৩ বছর মাত্র, সেহেতু তার স্তন পূর্ণ রূপে বিকশিত হয়নি। সুতরাং অভিযুক্তের বিরুদ্ধে নাবালিকার স্তন-স্পর্শের যে অভিযোগ উঠছে তা বৈধ নয়, এমনটাই ছিল দাবি। যা এক কথায় খারিজ করে দিলেন বিচারপতি বিবেক চৌধুরী। অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে তিনি জানান, নাবালিকার স্তন পূর্ণ বিকশিত হয়েছে কি হয়নি, তা এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক। যদি কোনও কারণে স্তনগ্রন্থির বিকাশ না-ও হয়, যদি শারীরিক কোনও সমস্যা থেকেও থাকে, তাহলেও ১৩ বছরের নাবালিকার বক্ষকে স্তন হিসাবেই বিবেচনা করা হবে, এবং তা স্পর্শ করা যৌন হেনস্তাই। ঘটনায় অভিযুক্তের যৌন হেনস্তার উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়েছেই বলেই সাফ জানালেন বিচারক। তাঁর প্রশ্ন, ঠিক কী কারণে একজন পরিণতবয়স্ক মানুষ ফাঁকা ঘরে গিয়ে নাবালিকাকে জোর করে চুমু খায়, এবং তার শরীরে আপত্তিকর ভাবে স্পর্শ করে? যৌন হেনস্তার উদ্দেশ্য ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রমাণ থেকেই চিহ্নিত করা যায় বলে মত প্রকাশ করেছেন বিচারক। আর তাই এক্ষেত্রে বিচারক নিম্ন আদালতের রায় বজায় রেখে অভিযুক্তকে দোষীই সাব্যস্ত করেছেন।
নাবালিকা হেনস্তা রুখতে কলকাতা হাই কোর্টের এই রায় যুগান্তকারী বলেই মনে করছেন অনেকে। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৪৮ ধারা অনুযায়ী একজন নারীর সম্মানহানি করার যে অপরাধ, সে আইনের ফাঁকই যেন আবিষ্কার হয়েছিল বম্বে হাই কোর্টের রায়ে, যা মারাত্মক এক প্রবণতা বলেই অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। আইনের এই ফাঁক গলে বহু অপরাধীই নিষ্কৃতী পেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছিল। যদিও কলকাতা হাই কোর্ট সে সম্ভাবনা সম্পূর্ণ রূপে খারিজ করল। নাবালিকার বক্ষ পূর্ণ বিকশিত হোক বা না হোক তা স্তন-ই এবং তা স্পর্শ করা পকসো আইনের আওতায় অপরাধই। এই সিদ্ধান্ত যে নাবালিকা হেনস্তা রোখার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে দৃষ্টান্তমূলক হয়ে উঠবে, তা বলাই যায়।