তাঁর আসল নাম যে কী ছিল, সে কথা আজ আর কারওর মনে নেই। তবে তিনিই ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুধার্ত মানুষ। হাতের যা সামনে পেতেন মুখে পুরে দিতেন টপাটপ। তবু খিদে মিটত না। তাঁর রেশন জোগাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হত সেনাবাহিনীকে। তবে সেই আশ্চর্য ক্ষমতার জেরেই নাকি হয়ে উঠেছিলেন সেনাবাহিনীর গুপ্তচর। শুনে নিন, তারারের সেই আশ্চর্য খিদের গল্প।
“অল্পেতে খুশি হবে দামোদর শেঠ কি?” -তা দামোদর শেঠ খুশি হতেন কিনা জানা নেই, খাবার খাইয়ে এই ব্যক্তিকে খুশি করা ছিল অসম্ভব কাজ। আস্ত একটা শূকর খেয়েও পেট ভরত না তাঁর। খিদে পেলে হাতের কাছে যা পেতেন তুলে মুখে পুরে দিতেন। জ্যান্ত কুকুর বিড়ালরা পর্যন্ত ভয়ে ধারকাছ মাড়াত না। ফ্রান্সে এককালে তারারে নামে ছিলেন এমনই এক ব্যক্তি। যাঁর অসীম খিদে ও খাওয়ার ক্ষমতা অবাক করে দিয়েছিল চিকিৎসাশাস্ত্রকেও।
তারারের জন্ম ১৭৭২ সালে। ছোটবেলায় তাঁর খাবারদাবারের খরচা না সামলাতে পেরে ছেলেকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন বাবা-মা। বাড়ি ছেড়ে আসার পর ঘুরে ঘুরেই দিন কাটত তাঁর। কখনও নিষিদ্ধপল্লীর ব্যান্ডপার্টির সঙ্গে তো কখনও চোরের দলের সঙ্গে সে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতেন। কখনও পাথর খেয়ে দেখাতেন তো কখনও জ্যান্ত জন্তু তুলে মুখে পড়ে দিতেন। তাঁকে দেখতে ভিড় জমে যেত রাস্তায়। ১৭৮৮ সাল নাগাদ প্যারিসে চলে আসেন পাকাপাকি ভাবে। রাস্তায় খেলা দেখিয়েই দিন চলছিল। কিন্তু এরই মধ্যে গোল বাঁধাল তাঁর পেটের সমস্যা। হাসপাতালেও ভর্তি হতে হল তাঁকে। সেখানেও নিজের ভেলকি দেখাতে আগ্রহী তিনি। খোদ ডাক্তারকেই তাঁর ঘড়ি আর চেন গিলে দেখানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি।
আরও শুনুন: সদ্যোজাতর নাম রাখাই পেশা, উপার্জনের অঙ্কে চমক লাগছে নেটিজেনদের
তা এ হেন তারারে ১৭৯০ সালে যোগ দিলেন ফরাসি সেনা দলে। তবে সেখানকার রেশনে পেট ভরানো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল তাঁর। তাই অন্য সৈনিকদের হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে লড়ে আসতেন তারারে। তার বদলে সেই সৈনিকের রেশনটুকু দখল করতেন তিনি। তার পরেও সেনাবাহিনীর ওই সব সাধারণ খাবারদাবারে তারারের মতো মানুষের পুষ্টি মেলে নাকি! সর্বক্ষণই ক্লান্ত দেখাত তাঁকে। অসুস্থ তারারেকে ভর্তি করা হল সেনাহাসপাতালে। চিকিৎসকেরা চার গুণ করে দিলেন তাঁর রেশন। তবু পেট আর ভরে না তারারের। ব্যাপারটি বোঝার জন্য তাঁকে আরও কদিন হাসপাতালে রাখলেন মিলিটারি সার্জেন প্রফেসর পার্সি।
কিছুদিন যেতে না যেতেই কাজে ফেরার নোটিস-সহ সেনাবিভাগের চিঠি পৌঁছল হাসাপাতালে। কিন্তু তারারের মতো ‘সাবজেক্ট’-কে কিছুতেই ছাড়তে মন চায় না ডাক্তার পার্সির। তাঁর উপরে আরও কিছু পরীক্ষানিরিক্ষা যে বাকি রয়ে গিয়েছে। পার্সি একদিন একটা কাঠের বাক্সয় একটা কাগজ রেখে সেটা খেতে দিলেন তারারেকে। তিনি সেটা খেলেন তো বটেই, দুদিন পর অবিকৃত অবস্থায় সেই বাক্স এবং কাগজ দুটোকেই মলের সঙ্গে বের করেও দিলেন। ব্যাস, খবর গেল সেনাবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে। এই আশ্চর্য ক্ষমতার জেরেই তারারে হয়ে উঠলেন ফরাসি সেনার গুপ্তচর। প্রাসিয়া দুর্গে বন্দি ফরাসি কর্নেলকে খবর পাঠাতে প্রথম বার ব্যবহার করা হল তাঁকে।
তবে তারারের উপরে ততটা বিশ্বাস করতে পারেননি ফরাসি জেনারেল। তাই প্রথম বার চিঠিতে তেমন কিছুই লিখলেন না তিনি। আর সেইবারই ধরা পড়ে গেলেন তারারে। মারধর, হাজার রকম অত্যাচারেও প্রথমে মুখ খোলেননি তারারে। তবে প্রাসিয়ার সেনার থার্ড ডিগ্রির মুখে শেষমেশ সত্যিটা বলতে বাধ্য হন। ৩০ ঘণ্টা তাঁকে একটানা খাওয়ানোর পরে শেষপর্যন্ত বাক্সটা বের করে দেন তারারে। আর সেই চিঠি দেখে এতটাই রেগে গিয়েছিল প্রাসিয়ানরা, যে তারারেকে ফাঁসিতে ঝোলানোর বন্দোবস্ত প্রায় করেই ফেলেছিলেন তাঁরা। শেষপর্যন্ত অবশ্য রেহাই পান তারারে।
আরও শুনুন: লম্বা লেজ কিশোরের, পরিবারের বিশ্বাস পুনর্জন্ম হয়েছে স্বয়ং বজরংবলীর
তবে এবারের ঘটনায় কিন্তু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন তারারে নিজেই। হাসপাতালে ফিরে ডাক্তার পার্সির হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করেন তাঁকে সারিয়ে তোলার জন্য। পার্সিও চেষ্টার ত্রুটি করেননি। তবে বাগে আনা যায়নি তারারের ভয়ানক খিদেকে। ১৫ জন শ্রমিক যতটা খান, তাঁর চেয়েও বেশি পরিমাণ খাবার একা খেতেন তারারে। তার সঙ্গে চার গ্যালন দুধ! আর এসব খেয়ে তৎক্ষনাৎ ঘুমে ঢলে পড়তেন। একবার নাকি আস্ত একটা জ্যান্ত বিড়াল খেয়ে ফেলেছিলেন তিনি। সাপখোপ, টিকটিকি থেকে শুরু করে কুকুর- কোনও কিছুই বাঁচত না তারারের প্রচন্ড খিদের হাত থেকে। গোটা একটা ইলমাছ জ্যান্ত গিলে দেখিয়েছিলেন তারারে। আশ্চর্যের কথা, এত সব খাওয়ার পরেও ওজনে বিশেষ তারতম্য দেখা যেত না তাঁর। কিশোর বয়স থেকেই তাঁর ওজন ছিল ১০০ পাউন্ডের কাছাকাছি। তবে তাঁর চোয়ালটি ছিল অসম্ভব রকমের বড়। আর পেটের চামড়াটিও বড় একটা চামড়ার ব্যাগের মতো ঝুলে থাকত বাইরের দিকে। তার উপর গায়ে ছিল ভয়ঙ্কর রকমের দুর্গন্ধ।
হাসপাতালে থাকাকালীনও ভয়ঙ্কর সব কাজকর্ম করে বেড়াতেন তারারে। খিদের চোটে হাসপাতালের মর্গে পর্যন্ত হানা দিয়েছেন কয়েকবার। হাসপাতালের বাকি চিকিৎসকেরা তাঁকে পাগলাগারদে রাখতে চাইলে বাধা দিতেন পার্সি। তবে একবার হাসপাতাল থেকে শিশু গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনায় আঙুল ওঠে তারারের দিকে। আর তার পরে আর তাঁকে বাঁচানো যায়নি। পরে মারাত্মক কলেরা ও যক্ষার শিকার হয়ে মারা যান তারারে। তবে তাঁর এই অস্বাভাবিক রকমের খিদের কারণ কিন্তু আজও চিকিৎসকদের কাছে রহস্যই থেকে গিয়েছে। আর তারারে রয়ে গিয়েছেন ইতিহাসের এক আশ্চর্য মানুষ হয়ে।