দ্রুত পৌঁছে দিতে হবে খাবার। বা নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। যে সংস্থা গ্রাহকের থেকে অর্ডার নিয়েছে, তার প্রতিশ্রুতি সেরকমই। আর তা রক্ষা করতেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পড়িমরি করে ছুটছেন ডেলিভারি বয়রা। সামান্য দেরি হলেই গ্রাহকের অসন্তোষ। তার প্রভাব আবার পড়বে চাকরিতে। এই ভয়েই ছুটছেন তাঁরা। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, আমাদের অর্থাৎ গ্রাহকদের চটজলদি জিনিস পাওয়ার চাহিদাই হয়তো বড় বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এই মানুষগুলোকে। একটা প্রশ্ন তাই আমাদের দিকেই ফিরে ফিরে আসে, একটু কি সবুর করা যায় না?
রাত ফুরনোর আগে পৌঁছে দিতে হবে চিঠি। ফলত দৌড়… আরও জোরে, আরও জোরে। এই ছিল রানারের নিয়তি। পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু সে টাকাকে যাবে না ছোঁয়া। সে-যুগ বদলেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা আজ আমাদের হাতের মুঠোয়। আজ আর চিঠি কিংবা টাকার জন্য কেউ অপেক্ষা করেন না হয়তো। তবু অপেক্ষা কিন্তু একেবারে যায়নি। এখন অপেক্ষা চটজলদি খাবার বা জরুরি সামগ্রী হাতে পাওয়ার। আজ তাই পিঠেতে খাবারের বোঝা, তবু সে খাবার যাবে না ছোঁয়া। রানারের নিয়তি এখন ডেলিভারি বয়দের। সংস্থার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে দ্রুত বাইক ছোটাচ্ছেন তাঁরা।
আরও শুনুন: মন্দির চত্বরেই আয়োজন ইফতারের, মুসলমান পড়শিদের আমন্ত্রণ স্বয়ং পুরোহিতের
যত দিন যাচ্ছে, তত এই দ্রুত জিনিস পৌঁছে দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। যে সব সংস্থা অর্ডার নেয়, তারা যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এ যদি বলে ২০ মিনিট সময় লাগবে, পালটা অন্য সংস্থা বিজ্ঞাপন দিয়ে জানায়, ১০ মিনিটেই জিনিস পৌঁছে যাবে। গ্রাহকদের চাহিদা মেনেই এই প্রতিযোগিতা। সকলেই চান, চাওয়া মাত্র জিনিস হাজির হয়ে যাক দরজায়। কিন্তু কোনও অলৌকিক ক্ষমতায় তো এ কাজ সম্ভব হয় না। এই চটজলদির দাবি পূরণ করতে হয় সাধারণ মানুষকে। যাঁদের আমরা ডেলিভারি বয় বলে থাকি। সংস্থার প্রতিশ্রুতি আর গ্রাহকের চাহিদার ভিতর তাঁরা অহরহ দৌড়তে থাকেন। তাঁদের ঘাম আর শ্রমের বিনিময়েই আমাদের চাহিদাপূরণ হতে থাকে। আমরা কি ভেবে দেখেছি আদৌ, এই দৌড়ের চক্করে কতখানি জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন তাঁরা! বোধহয় না। গ্রাহক যদি সামান্য সবুর করতেন, তাহলে সংস্থাগুলি এমন প্রতিযোগিতায় নামার সিদ্ধান্ত হয়তো নিত না।
আরও শুনুন: ‘অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক…’, ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ প্রসঙ্গে এবার মুখ খুললেন শরদ পাওয়ার
পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন এই ডেলিভারি বয়রা। যত দ্রুত সম্ভব বাইক ছোটাচ্ছেন তাঁরা। আমরা সকলেই জানি, এতে কতখানি দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে। সিগন্যাল সবুজ হওয়া মাত্রই সাঁ করে ছুটে যায় তাঁদের বাইক। দুর্ঘটনাও ঘটে। তবে তার খতিয়ান বিশেষ কিছু থাকে না। কেউ কেউ আবার ভাগ্যজোরে রেহাই পেয়েছেন বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে। পেশাগত ঝামেলা হিসাবেই তাঁরা মেনে নিয়েছেন এ বাস্তবতাকে। কিন্তু এ কথা তো মানতে হবে যে, মানুষ রোবট নয়। তাই যে দ্রুততার চাহিদা এঁদের এমন ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে, তার দায়ভার অনেকাংশে গ্রাহকের উপরই এসে বর্তায়। পথসচেতনতা নিয়ে আমরা অনেকেই সচেতন। পরিবার পরিজন বাড়ির বাইরে বেরোলে তাদের সাবধান করে দেওয়া আমাদের স্বাভাবিক অভ্যাস। সেই আমরাই আবার এমন এক ব্যবস্থাকে প্রশ্রয় দিচ্ছি, যাতে চাকরি রক্ষার তাগিদে ঝুঁকিকেই মেনে নিতে হচ্ছে বহুসংখ্যক মানুষকে। এই অভ্যাস বদলানোর অবকাশ একদম যে নেই তা কিন্তু নয়। এ কথা ঠিক, বর্তমান সময়ে আমাদের ধৈর্য অনেকাংশে কমেছে। চট করে কিছু জিনিস পাওয়া বা তাৎক্ষণিক চাহিদাপূরণ প্রায় আসক্তির পর্যায়ে চলে গিয়েছে। প্রায় জেনেবুঝেই আমরা এই প্রবণতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছি।
আরও শুনুন: দেশরক্ষাই ধর্ম, রমজান পালনের মধ্যেও কর্তব্যে অবিচল ইউক্রেনের মুসলমান সৈনিকরা
ঝুঁকি জেনেও বহু মানুষ এই পেশাকে গ্রহণ করছেন। করোনাকালে উপার্জনের বিভিন্ন পথ বন্ধ হয়েছে। এদিকে স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখার কারণে মানুষের বাইরে বেরনো যেহেতু বাধ্যতামূলক হয়েছিল, তাই পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল অর্ডার দিয়ে জিনিস আনিয়ে নেওয়ার প্রবণতা। ফলত পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকেই কাজের সুযোগ পেয়েছেন এবং রুটি রুজির তাগিদে বেছে নিয়েছেন ডেলিভারি বয়ের কাজ। তাঁরা জানেন, এ কাজে ঝুঁকি আছে বিস্তর, কিন্তু পেটের টানেই সে ঝুঁকি নিতে রাজি হয়েছেন তাঁরা। গ্রাহকের দ্রুত জিনিস পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা যত বেড়েছে, সংস্থাগুলি তত পাল্লা দিয়ে প্রতিযোগিতেয় বনেমেছে। অর্থাৎ এমন একটা ব্যবস্থা বা চক্র তৈরি হয়েছে যাতে কিছু মানুষের ঝুঁকিবহুল দৌরে চলা যেন ভবিতব্য হয়ে গিয়েছে।
এইখানেই একটি প্রশ্ন ঝুলে থাকে। জীবনদায়ী ওষুধপত্র হলে আলাদা কথা, কিন্তু সামান্য খাবার বা মুদি সামগ্রী পাওয়ার জন্য আমরা কি খানিকটা ধৈর্য ধরতে পারি না! গ্রাহক যদি সবুর করেন তাহলেই হয়তো সংস্থাগুলি প্রতিযোগিতা খানিকটা কমায়। তাতে এই মানুষগুলোর ঝুঁকি সামান্য হলেও কমে। সংস্থাগুলি গ্রাহকের অভ্যাসে বদল আনবে না। বদল আনতে পারে সাধারণ মানুষই। হয়তো আগামী দিনে এই পরিষেবা দেওয়া সম্ভব হবে ড্রোনের মাধ্যমে। কিন্তু যতদিন না তা হচ্ছে, আমরা কি আমাদেরই মতো বহু মানুষের দিকে তাকিয়ে ধৈর্য ধরার অনুশীলন করতে পারি না? এর উত্তর খুঁজতে আমাদের প্রত্যেককেই।