মাত্র ২০ বছর বয়সেই শেষ হয়ে গিয়েছিল জীবনের উড়ান। কিন্তু তার মধ্যেই নিজের স্বপ্ন ছুঁয়েছিলেন তিনি। প্রথম বাঙালি হিসেবে বিমানচালকের খেতাব তাঁরই দখলে। কেবল বাংলা নয়, ভারতেও প্রথম এবং একমাত্র ‘ফ্লায়িং এস’ বা ‘ফাইটার এস’ খেতাব পেয়েছেন তিনিই। আসুন, শুনে নেওয়া যাক ইন্দ্রলাল রায়ের কথা।
মাত্র ২০ বছর সময় পেয়েছিলেন তিনি। এত দ্রুত জীবনটা ফুরিয়ে যাবে বলেই কি গতির প্রতি এমন অমোঘ টান অনুভব করতেন ইন্দ্রলাল রায়? পথে নামলে মোটরবাইক, আর আকাশে বিমান, এই দুইয়ের সঙ্গেই যেন জীবনের তার বাঁধা ছিল এই তরুণের। স্বল্পমেয়াদি জীবন, কিন্তু তার মধ্যেও নিজের স্বপ্নের সঙ্গে আপস করেননি এতটুকু। তাই প্রতিদান ফিরিয়ে দিয়েছিল জীবনও। ওই বয়সেই ‘ফ্লায়িং এস’ খেতাব পেয়েছিলেন তিনি, যা বাংলা এবং ভারতের ঝুলিতেও প্রথম ‘ফ্লায়িং এস’ সম্মান। বিশ্বযুদ্ধে অদম্য লড়াইয়ের সুবাদে ভারতের তৎকালীন শাসক ব্রিটিশ শক্তির হাত থেকেই এই শিরোপা অর্জন করেছিলেন প্রথম বাঙালি বিমানচালক ইন্দ্রলাল।
আরও শুনুন: নতুন স্বাদের রান্নায় মুগ্ধ ভিনদেশিরা, জাপানি রেস্তরাঁর হাল ধরেছিলেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু
কী এই ‘ফ্লায়িং এস’ বা ‘ফাইটার এস’ সম্মান? যে কোনও বিমানচালক নন, কেবল ফাইটার পাইলটেরাই পান এই বিশেষ সম্মান। আকাশযুদ্ধে শত্রুপক্ষের অন্তত পাঁচটি বা তার বেশি সংখ্যক বিমান গুলি ছুঁড়ে মাটিতে নামাতে পেরেছেন যিনি, সেই ফাইটার পাইলটকেই এই খেতাব দেওয়া হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯১৫ সালে সেনাবাহিনীতে এই খেতাবের প্রচলন হয়েছিল। আর সেই বিশ্বযুদ্ধে লড়াই করেই এই খেতাব পেয়েছিলেন ইন্দ্রলাল।
ব্রিটিশ অনুগত ছিলেন বাবা, তাই ছোটবেলাতেই পরিবারের সঙ্গে দেশ ছেড়ে পাকাপাকিভাবে লন্ডনে চলে যান ইন্দ্রলাল। যখন তাঁর বয়স বছর পনেরো, তখনই সে দেশে বেজে উঠল বিশ্বযুদ্ধের দামামা। ব্রিটিশ আর্মিতে যোগ দিলেন তাঁর দাদা। কিন্তু যুদ্ধে যোগ দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও বাধা হয়ে দাঁড়াল স্কুলপড়ুয়া ইন্দ্রলালের বয়স। তবে হাল ছাড়লেন না তিনি। স্কুলের ক্যাডেট ফোর্সে অনুশীলন চালাতে চালাতেই ঠিক করে ফেললেন, যুদ্ধবিমান চালাবেন একদিন। প্রথম সুযোগেই আবেদন করলেন রয়্যাল ফ্লাইং কর্পস-এ ভরতি হওয়ার জন্য। কিন্তু অপ্রতুল দৃষ্টিশক্তির কারণে ব্যর্থ হলেন। তবুও হাল ছাড়ার মানুষ ছিলেন না ইন্দ্রলাল। চক্ষুপরীক্ষার জন্য তিনি পৌঁছে গেলেন বিলেতের অন্যতম সেরা চক্ষুবিশেষজ্ঞের কাছে। ফিজ মেটানোর জন্য প্রিয় মোটরবাইকটি বিক্রি করতেও দুবার ভাবেননি। জেদের ফল মিলল। দৃষ্টিশক্তির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ব্রিটেনের বিমানবাহিনীতে যোগ দিলেন ইন্দ্রলাল। তখন তাঁর বয়স সবে আঠেরো পেরিয়েছে।
আরও শুনুন: জ্বলছে মোমবাতি, চলছে মন্ত্রপাঠ, সামনে রাখা খুলি… কী হত ঠাকুরবাড়ির গুপ্তসভায়?
এই জেদ আর সাহসের দরুন যুদ্ধক্ষেত্রে একের পর এক জয় ছিনিয়ে এনেছিলেন ইন্দ্রলাল। যোগদানের কয়েক মাস পরেই জার্মান যুদ্ধবিমানের গুলিতে ভেঙে পড়েছিল তাঁর বিমান। অজ্ঞান, ক্ষতবিক্ষত ইন্দ্রলালকে মৃত মনে করে মর্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জ্ঞান ফিরে আসার পর চেঁচামেচি করে সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। সেরে উঠতে না উঠতেই ফের নেমে পড়েন যুদ্ধের ময়দানে।
পরের বছর, ১৯১৮ সালের জুলাই মাসে ৯ থেকে ১৯ তারিখের মধ্যে নটি জার্মান যুদ্ধবিমানকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন ইন্দ্রলাল। কিন্তু ২২ তারিখ চারটি জার্মান বিমানের একত্র হামলা রুখতে গিয়ে ভেঙে পড়ল তাঁর বিমান। এবার আর অমন ‘মিরাকল’ ঘটিয়ে ফিরে আসতে পারলেন না ইন্দ্রলাল। স্বপ্নকে ছুঁয়েই শহিদ হলেন তিনি। রয়ে গেল কেবল এক রূপকথা। যেখানে লেখা রইল বিশ বছরের এক বাঙালি ছেলের জিতে যাওয়ার গল্প।