বসন্তের দিনে ফের মর্তে আসেন দেবী দুর্গা। এক রূপে নয়, পৃথক পৃথক রূপে আরাধনা হয় তাঁর। কোথাও তিনি বাসন্তী পূজার অধিষ্ঠাত্রী দুর্গা, কোথাও বা তিনি নবরাত্রির শেরাওয়ালি দেবী, কখনও আবার তিনি ধারণ করেন অন্নপূর্ণা রূপ। পৃথিবীর অন্নকষ্ট দূর করেন এই দেবী, এমনটাই বিশ্বাস করেন ভক্তরা।
পুরাণ মতে, দুর্গাপূজার আদি সময় ছিল বসন্তকালেই। শরতে রামচন্দ্র দেবীর অকালবোধন করার পর শারদীয়া দুর্গোৎসবের সূচনা হয়, কিন্তু বাসন্তী পূজাই আদি দুর্গোৎসবের আখ্যা পেয়েছে। এই বাসন্তী পূজার প্রচলনও করেছিলেন রামের মতোই এক রাজ্য হারানো রাজা। রাজা সুরথ, সমাধি নামে এক বৈশ্যের সঙ্গে মিলে ঋষি মেধসের আশ্রমে মূর্তি গড়ে দেবী দুর্গার আরাধনা করেন। বসন্তকালের সেই দুর্গা আরাধনা থেকেই দুর্গাপূজার সূচনা। আর এই বাসন্তী পূজার অষ্টমী তিথিতে পূজা হয় দেবী অন্নপূর্ণার।
আরও শুনুন: দোলপূর্ণিমা তিথিতেই আবির্ভাব মহাপ্রভুর, কেন তখন হয়েছিল চন্দ্রগ্রহণ?
দেবী পার্বতীরই আরেক রূপ দেবী অন্নপূর্ণা কিংবা অন্নদা। অন্নদাত্রী রূপে কল্পনা করা হয় এই দেবীকে। দ্বিভুজা অন্নপূর্ণার এক হাতে অন্নপাত্র ও অন্য হাতে হাতা থাকে। দেবীর একপাশে থাকেন ভূমি ও অন্যপাশে থাকেন শ্রী। কেবল মর্তবাসী নয়, স্বয়ং শিবকেও অন্নদান করেন দেবী অন্নপূর্ণাই, এমন কথাই জানায় পুরাণ। পৌরাণিক মতে, হিন্দুদের পরম পবিত্র তীর্থস্থান কাশীর সঙ্গেও জুড়ে আছেন এই অন্নদাত্রী দেবী।
কাশী এবং অন্নপূর্ণার সেই যোগসূত্রটি কী? আসলে দক্ষযজ্ঞে সতীর দেহত্যাগ, শিবের তাণ্ডব এবং উমার দীর্ঘ তপস্যার শেষে তাঁদের মিলনের কথা বর্ণনা করেছে পুরাণকাহিনি। অবশেষে কৈলাস পর্বতে শিব-পার্বতীর সুখের সংসার। কিন্তু সুখ সইল না বেশিদিন। দারিদ্র্যের জেরে অশান্তি, কলহ শুরু হল দেবদেবীর সংসারেও। আর কষ্ট সইতে না পেরে কৈলাস ত্যাগ করলেন পার্বতী। এদিকে দেবী চলে যেতেই গোটা কৈলাস জুড়ে দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। সকলকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে নিজের কাঁধে ভিক্ষার ঝুলি তুলে পথে বেরোন দেবাদিদেব মহাদেব। কিন্তু দেবীর মায়ায় কোথাও ভিক্ষেও পান না তিনি। অবশেষে তাঁর কানে আসে, কাশীতে এক নারী সকলকে অন্ন দান করছেন। ক্ষুধার্ত শিব সেখানে পৌঁছে দেখেন, সেই নারী আর কেউ নন, স্বয়ং দুর্গা। দেবীর কাছ থেকে মুষ্টিভিক্ষা নিয়েই ভক্তদের খাদ্যের জোগান দেন শিব। সঙ্গে দেবীর এই অন্নদাত্রী রূপের এক মন্দিরও কাশীতে স্থাপন করেন তিনি।
আরও শুনুন: তিনি দেবী, আবার নদীও… এককালে কৃষির দেবী হিসেবেও পূজা পেতেন সরস্বতী
শোনা যায়, কাশীর অন্নপূর্ণা দর্শনে বেরিয়েই দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন রানি রাসমণি। যার ফলশ্রুতিতে দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন রানি। কিন্তু তা সত্ত্বেও অন্নপূর্ণা দর্শনের ইচ্ছা থেকেই গিয়েছিল তাঁর জামাতা মথুরমোহন বিশ্বাসের মনে। মথুরাবাবুর সেই ইচ্ছার মর্যাদা দিয়ে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের আদলে দেবী অন্নপূর্ণার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর স্ত্রী, রানি রাসমণির ছোট মেয়ে জগদম্বা দেবী। আজকের ব্যারাকপুর শহরে এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই মন্দির। তবে বাংলায় অন্নপূর্ণা পূজার প্রসার ঘটেছিল রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের রচিত ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের প্রভাবে, এমন কথাও মনে করেন অনেকে।