সানাই বাজাতে প্রচুর দম লাগে। সানাই বাজানো তাই মেয়েদের কাজ নয়। সেই ধারণাটাকেই বদলে দিয়েছিলেন দিল্লির এই কন্যে। নাড়া বেঁধেছিলেন খোদ বিসমিল্লা খাঁয়ের কাছে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রথম এবং একমাত্র মহিলা সানাই বাদক হয়ে উঠতে গিয়ে কম বাধার পাহাড় টপকাতে হয়নি বাগেশ্বরীকে। আসুন, শুনে নিই, তাঁর সেই পাহাড় ভাঙার গল্প।
তার ‘রাগিণীতে বৈরাগিণী ওঠে যেন জেগে’। সানাইয়ের মনকেমন করা সুর নিয়ে এমনটাই লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সত্যিই, আশ্চর্য মাধুরী এই বাদ্যযন্ত্রের। সুরের মধ্যে জেগে থাকে অদ্ভুত বিষাদ। অথচ দেখুন, এ বাদ্যযন্ত্র তো বাঙালি সমাজে আনন্দ অনুষ্ঠানের সঙ্গী। এককালে বিয়ে থেকে শুরু করে প্রায় সমস্ত মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানই ছিল সানাইয়ের সুর ছাড়া অসম্পূর্ণ। বড় বড় সব বিয়েবাড়িতে এককালে বসত নহবত। সেখানে বাজাতেন নামীদামী সব ওস্তাদরা। তবু একটা সময় পর্যন্ত ধ্রুপদী সঙ্গীতের ধারায় বিশেষ মান ছিল না এই বাদ্যযন্ত্রটির। সানাইসম্রাট বিসমিল্লা খাঁ-এর হাত ধরে জাতে উঠল এই যন্ত্র। ধ্রুপদী সঙ্গীতের ভুবনে পা রাখল সানাই। তবে এই সানাইয়ের জগত আজও যেন বড্ড বেশি পুরুষপ্রধান। সেখানে মহিলাশিল্পী প্রায় নেই বললেই চলে। ব্যতিক্রম কেবল একজন। তিনি বাগেশ্বরী কামার। ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের ঘরনায় প্রথম এবং একমাত্র মহিলা সানাইশিল্পী।
আরও শুনুন: দেশে প্রথম মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা, লড়াইয়ের অপর নাম সাবিত্রীবাই ফুলে
নামেই তাঁর সরস্বতী। আক্ষরিক অর্থেই সরস্বতী আসন বিছিয়ে বসেছিল বাগেশ্বরীর বাদ্যযন্ত্রে। যদিও তাঁর বেড়ে ওঠা সঙ্গীতের পরিমন্ডলেই, তবু মেয়ে হিসেবে সানাইয়ের দুনিয়ায় পা রাখাটা সহজ ছিল না। তখন মাত্র বছর ছয়েক বয়স তাঁর। সানাইটা বোধহয় উচ্চতায় তার চেয়েও কিছুটা বেশিই ছিল। তার উপর ফুঁঃ দিয়ে বাজানোর যন্ত্র। দমের দরকার হয় প্রচুর। বাবার কাছে গিয়ে প্রথম যেদিন জানিয়েছিলেন, তিনি সানাই বাজাতে চান। প্রথম কথাতেই নাকচ করে দিয়েছিলেন বাবা। ‘ইয়ে কাম লডকিও কা নহি হ্যায়’- বলেছিলেন তিনি।
বাড়িতে তিন প্রজন্ম ধরে সানাই বাজানোর চল। দাদু দীপ চাঁদ ছিলেন বিশ শতকের এক জন নামী সানাইবাদক। খোদ বিসমিল্লা খাঁয়ের কাছে সানাইয়ের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন বাবা জগদীশ প্রসাদ কামার।
পাখির ডাকে নয়, পুরনো দিল্লির ইদগাহ রোডে প্রতিবেশীদের ঘুম ভাঙত সানাইয়ের শব্দেই। হ্যাঁ, ওই বাড়িতেই কয়েক পুরুষ ধরে বাস কামার পরিবারের।
বাবার আপত্তি সত্ত্বেও নিজের মতো করেই সানাই শেখার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন বাগেশ্বরী। পাশে ছিলেন মা। প্রায় বছর তিনেক পরে একদিন মেয়ের সানাই শোনেন জগদীশপ্রসাদ। চমকে উঠেছিলেন শুনে । মেয়েকে নিয়ে যান স্বয়ং গুরুজির কাছে। বাগেশ্বরীর সানাই শুনে রাজি হয়ে যান বিসমিল্লা খাঁ। দিল্লি ছেড়ে বারাণসীতে গুরুর বাড়িতে থেকেই শুরু হয় বাগেশ্বরীর প্রশিক্ষণ।
আরও শুনুন: এককালে করেছেন বাসন মাজার কাজও, সেই দুলারী দেবীর সৃষ্টিতেই এখন গর্বিত দেশবাসী
সানাই বাজাতে শ্বাসযন্ত্রের জোর লাগে। আর সেই কারণেই বোধহয় এই ক্ষেত্রটায় মহিলাদের আনাগোনা কম। তবে সেই ট্যাবুটাই ভাঙতে চেয়েছিলেন বাগেশ্বরী। খুব কম সময়েই বিসমিল্লাজির প্রিয়পাত্রী হয়ে উঠলেন তিনি। যতদিন বিসমিল্লা খাঁ বেঁচে ছিলেন, তাঁর কাছ থেকে শিখে গিয়েছেন বাগেশ্বরী। ১৯৮৩ সালে প্রথম মঞ্চে অনুষ্ঠান। সেই কনসার্টটি হয়েছিল মহিলা বাদ্যযন্ত্রকারদের নিয়েই। সেখানে প্রথম মহিলা সানাই বাদক হিসেবে প্রচুর প্রশংসা পান বাগেশ্বরী। গুরু বিসমিল্লা খাঁ একবার ঠিক করলেন, বাগেশ্বরীকে নিয়ে যুগলবন্দির আসর করবেন তিনি। মেয়েদের সঙ্গে যুগলবন্দি করবেন স্বয়ং সানাইসম্রাট! আশপাশ থেকে ছুটে এসেছিল শব্দবাণ। তবে সেসব কানে তোলেননি বিসমিল্লা খাঁ। সেই অনুষ্ঠানে সুরসম্রাটকে দিব্যি টক্কর দিয়েছিলেন বাগেশ্বরী।
বিয়ের পর যদি মেয়ের সঙ্গীতের পাঠ বন্ধ হয়ে যায়, সেই ভয়ে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে রাজি হননি বাবা। বরং জামাইকেই ডেকে নিয়েছিলেন দিল্লীর বাড়িতে। স্বামীর কাছ থেকেও সেই সম্মান আর জায়গাটুকু বরাবর পেয়েছেন বাগেশ্বরী।
প্রথম মহিলা সানাই বাদ্যকার। অথচ খুব কম মানুষই চেনেন বাগেশ্বরীকে। সঙ্গীতজগতের খ্যাতি, নাম- এত প্রতিভা সত্ত্বেও কেন দূরে রইলেন সেসবের থেকে? জানালেন, শুধুমাত্র নিজের শিল্পের কাছে দায়বদ্ধ তিনি। কিছুতেই গুরুজির তালিমের বাইরে যাবেন না। তাই আজও একান্তেই সুরসাধনায় মত্ত ভারতীয় সঙ্গীতের প্রথম ও একমাত্র মহিলা সানাইবাদক বাগেশ্বরী ।