কেবল ধর্মীয় তীর্থস্থান নয়। একদিকে অপূর্ব সুন্দর স্থাপত্য আর ভাস্কর্যের নিদর্শন। অন্যদিকে প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানচর্চারও সাক্ষ্য বহন করছে ওড়িশার কোনারক মন্দির। একটা দুটো নয়, গুনে গুনে ২৪টি সূর্যঘড়ির দেখা মেলে এই বিখ্যাত মন্দিরটিতে। লোকচক্ষুর সামনে থাকলেও অদ্ভুতভাবে আত্মগোপন করে রয়েছে সেই ঘড়িগুলি। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
বিজ্ঞান কিংবা গণিতের চর্চায় প্রাচীন কালেও নিজস্ব ছাপ রেখেছিল ভারতবর্ষ। আর সেই চর্চারই এক অভিনব নিদর্শন দেখা যায় ওড়িশার কোনারক মন্দিরে। সময়ের ধুলো আর একাধিক ভিনদেশি হামলার জের, দুয়ে মিলে অনেক ক্ষতি হয়েছে এই মন্দিরের। তবুও অক্ষত রয়ে গিয়েছে সেই চিহ্নগুলি।
আরও শুনুন: সম্প্রীতির নিদর্শন! ‘বিশ্বের বৃহত্তম হিন্দু মন্দির’ গড়তে জমি দান মুসলিম পরিবারের
ত্রয়োদশ শতকে সূর্যদেবের উপাসনার উদ্দেশ্যেই এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন রাজা নরসিংহদেব। সমুদ্র থেকে উঠে আসছে সূর্যদেবের রথ, আর তা টানছে সাতটি ঘোড়া, মন্দিরটির স্থাপত্যে এমন কল্পনাকে রূপ দিয়েছিলেন শিল্পীরা। আর সূর্যকে কেন্দ্র করেই সময়ের হিসেবও তাঁরা জুড়ে দিয়েছিলেন এই মন্দিরের গায়ে। কেমন সে হিসেব? শুনে নেওয়া যাক সে কথাই।
রথের আকৃতির মন্দিরটিতে থাকা ওই সাতটি ঘোড়ার মূর্তি আসলে সপ্তাহের সাতদিনের প্রতীক। রথের দুপাশে বারোটি করে মোট চব্বিশটি চাকা রয়েছে। যা বছরের চব্বিশটি পক্ষকে বোঝায়। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। পরখ করলে দেখা যায়, ওই চব্বিশটি চাকাই আসলে এক-একটি সূর্যঘড়ি। প্রাচীনকালে সূর্যরশ্মির উপর নির্ভর করে সময় গণনা করার যে পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন মিশরীয়রা, সেই সূর্যঘড়িকেই এই মন্দিরের স্থাপত্যের সঙ্গে নিপুণভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। একটি নির্দিষ্ট জায়গায় কোনও লম্বা জিনিস সোজা করে রাখলে তার উপরে পড়ে সূর্যের আলো, আর তার সাপেক্ষে ছায়া এসে পড়ে ওই ঘড়ির গায়ে। আর ওই আলো ছায়ার হিসেব কষেই সময় মাপতেন প্রাচীন যুগের মানুষেরা।
প্রাচীন কালে দিনের ২৪ ঘণ্টাকে ভাগ করা হত অষ্টপ্রহরে। তাই কোনারক মন্দিরের প্রতিটি চাকায় রয়েছে আটটি করে কাঁটা। অর্থাৎ এই দুটি কাঁটার মধ্যে রয়েছে তিন ঘণ্টার ব্যবধান। আবার দুটি বড় কাঁটার মধ্যে থাকা ছোট কাঁটাটি এক প্রহরকে ভাগ করেছে দুভাগে, অর্থাৎ দেড় ঘণ্টায়। একটি বড় কাঁটা আর একটি ছোট কাঁটার মধ্যে আবার রয়েছে ৩০টি উঁচু অংশ। যা দিয়ে রাখা হয়েছে মিনিটের হিসেব। দেড় ঘণ্টা সময়কে ভাগ করেছে ওই ৩০টি উঁচু অংশ। অর্থাৎ প্রতি অংশের ভাগে ৩ মিনিট করে সময়। ছায়া ওই অংশের বাঁদিকে, মাঝে আর ডানদিকে পড়ছে, এই হিসেবে এক-একটি উঁচু অংশ তিন মিনিট সময়ের হিসেব দেয়।
আরও শুনুন: জলে ডুবে থাকে গর্ভগৃহ, অহংকারেই নাকি হেলে পড়েছিল কাশীর এই মন্দিরের চূড়া
এমনই নিখুঁতভাবে সময়ের হিসেব দিত আটশো বছরের প্রাচীন কোনারক মন্দিরের এই ঘড়িগুলি। তবে এখানে সময় ঘুরত আজকের ঘড়ির কাঁটার ঠিক উলটোদিকে, অর্থাৎ অ্যান্টি-ক্লক ওয়াইজ। ভারতের প্রাচীন জ্ঞানচর্চার সাক্ষ্য বহন করে এখনও একইভাবে নির্ভুল সময় জানিয়ে চলেছে কোনারকের রথের চাকা।