গান্ধারী নাকি একশত পুত্রের জননী হয়েছিলেন। আর তিনি, সিন্ধুতাই, হাজার শিশুর মা। জন্মদাত্রী মা না হয়েও মায়ের চেয়েও বেশি কিছু। তাঁর গোটা জীবনটাই যেন এক আলো দেখানোর গল্প। অমানবিকতার, নিষ্ঠুরতার অন্ধকারে ভালবাসার আলো জ্বালাতে শিখিয়েছিলেন সিন্ধুতাই। আসুন, শুনে নেওয়া যাক এই মহীয়সী নারীর কাহিনি।
গর্ভে নয় মাসের সন্তান। প্রসবের দিন ঘনিয়ে আসছে। এই সময়েই, কুড়ি বছর বয়সি মাকে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়াতে হয়েছিল। সারা গায়ে মারধরের দাগ। পিছনে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল দরজা। চিরকালের জন্যই। রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে সেই অসহায়, বিপন্ন মেয়েটি সেদিন ভাবতেও পারেনি, একদিন সে নিজেই হয়ে উঠবে এমন অনেক অসহায় অনাথের আশ্রয়। আসলে বারবার জীবনের মার খেতে খেতে যারা ঘুরে দাঁড়ায়, তারা রূপকথার গল্প লেখে। যেমন লিখেছেন সেদিনের সেই মার-খাওয়া মেয়েটি, যাঁর পোশাকি নাম সিন্ধুতাই।
স্বাধীনতার ঠিক এক বছর পরেই জন্ম হয়েছিল সিন্ধুতাই-এর। যদিও তাঁর নিজের জীবনে স্বাধীনতা শব্দটি রয়ে গিয়েছিল অজানাই। গরিব মারাঠি পরিবারটি মাত্র দশ বছর বয়সেই মেয়ের বিয়ে দিতে পেরে নিশ্চিন্ত হয়েছিল। হোক না কুড়ি বছরের বড় বর, মেয়ে বিদায় করা গেলেই তো যথেষ্ট। স্বামী শ্রীহরি সাপকলের পরিবারে এসেও অবহেলা আর অত্যাচারই জুটেছিল সিন্ধুতাইয়ের ভাগ্যে। সেসব সয়ে কেটেও গিয়েছিল দশ-দশটা বছর। কিন্তু গ্রামে ঘটে চলা এক অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সেই আশ্রয়টাও হারালেন তিনি।
আরও শুনুন: দেশে প্রথম মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা, লড়াইয়ের অপর নাম সাবিত্রীবাই ফুলে
পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই। একটি গোয়ালঘরে কারো সাহায্য ছাড়াই সন্তান প্রসব করেন সিন্ধুতাই। কিন্তু খাবেন কী? ধর্মীয় গান গেয়ে ভিক্ষা করতে শুরু করেন তিনি। রাস্তায় থাকতে গিয়ে দেখেছিলেন পথে পথেই ঘুরছে অনেক শিশু। এদের নিজের চেয়েও বেশি অসহায় বলে মনে হয়েছিল তাঁর। তাই ভিক্ষে করে পাওয়া সামান্য অর্থে তিনি খাবার তুলে দিতেন আশেপাশের পথশিশুদের মুখেও। আর এভাবেই এই অসহায় শিশুদের আশ্রয় হয়ে ওঠেন তিনি। তাঁকে ঘিরে থাকা শিশুর সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। কেবল অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের ভার নয়, মনে মনে এই শিশুদের মানুষ করে তোলারও ভার নিয়েছিলেন সিন্ধুতাই। তাই তাদের শিক্ষার কথাও ভেবেছিলেন তিনি। এত কিছু করার মতো টাকা আসবে কোথা থেকে, জানতেন না। তবুও দমে যাননি তিনি। গ্রামে গ্রামে ঘুরে পথশিশুদের জন্য টাকা সংগ্রহ করতে শুরু করেন সিন্ধুতাই। মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন একটি কবরখানা, যেখানে অনেকের থাকায় অসুবিধা নেই। আক্ষরিক অর্থেই এই শিশুদের মা হয়ে ওঠেন শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত সেদিনের সেই গর্ভবতী মেয়েটি।
আরও শুনুন: ডাইনি অপবাদ থেকে পদ্ম সম্মান, অন্ধকারে আলো হয়ে জ্বলে ওঠার গল্প শোনান ছুটনি মাহাতো
চলতি বছরেই ৭৩ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন সিন্ধুতাই। জীবদ্দশায় হাজারেরও বেশি অনাথ শিশুর ভার নিয়েছিলেন তিনি। তাঁরই নেতৃত্বে চলত সাত-সাতটি অনাথ আশ্রম। তাঁর কাছে মানুষ হওয়া শিশুদের অনেকেই পরবর্তীকালে তাঁর কর্মকাণ্ডে যোগ দিয়েছিলেন। সিন্ধুতাই চলে গেলেন বটে, কিন্তু তাঁর জ্বালানো মঙ্গলপ্রদীপটি তাঁরাই জ্বালিয়ে রাখবেন, এমন আশা করাই যায়।