রাম না জন্মাতেই রামায়ণ। এমন কথা আমরা শুনেই থাকি। কিন্তু বড় কোনও বিপর্যয় ঘটার আগেই সে সম্বন্ধে লেখা হয়ে গিয়েছে, এমনটা ভেবে ফেলা সহজ নয়। অথচ বাস্তবে হয়েছিল তেমনটাই। ভয়াবহ টাইটানিক বিপর্যয়ের প্রায় ১৪ বছর আগে লেখা হয়েছিল এক উপন্যাস, যেখানে ছিল মস্ত এক জাহাজডুবির গল্প। আসুন আমরা সেই কথা শুনে নিই।
কেউ বলেন কাকতালীয়। কেউ বলেন লেখক ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। তাঁর কল্পনা অনেক আগে থেকেই দেখতে পায় আগামীকে। সে যাই হোক না কেন, ঘটনা এই যে, টাইটানিক ডুবে যাওয়ার এক দশকেরও আগে লেখা হয়েছিল একটি উপন্যাস। সেটি ছিল মস্ত এক জাহাজডুবির কাহিনি। হিমশৈলের চূড়ায় ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায় কাহিনির জাহাজ। হয় প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণহানি। যাত্রীদের মৃত্যুর কারণ ছিল জাহাজে পর্যাপ্ত সংখ্যক লাইফবোট না থাকা। বাস্তবে টাইটানিক বিপর্যয়ের সময় এই সমস্যাটিই বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। শুধু তাই-ই নয়, উপন্যাসে জাহাজটির নামের সঙ্গেও বাস্তবের সাদৃশ্য ছিল। কাহিনিতে জাহাজের নাম রাখা হয়েছিল ‘টাইটান’। কাল্পনিক জাহাজের সঙ্গে বাস্তবের টাইটানিকের আকারও মিলে গিয়েছিল। সামান্য বড় ছিল বাস্তবের টাইটানিক। ১৮৯৮ সালে মার্কিন লেখক মরগ্যান রবার্টসন লিখেছিলেন এই উপন্যাস, যার নাম ছিল ‘ফিউটিলিটি’। ঠিক এর ১৪ বছর পর, ১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিল ডুবে গিয়েছিল টাইটানিক।
আরও শুনুন: উচ্চতা ৬ ফুট ৯ ইঞ্চি, তাতেই বেসামাল পুরুষসঙ্গীরা! আজব সমস্যায় বিশ্বের সবথেকে লম্বা মডেল
প্রশ্ন হল, প্রায় দেড় দশক আগে লেখক এরকম জাহাজডুবির কল্পনা কীভাবে করেছিলেন? পুরোটাই কি কল্পনাশক্তির জোর! নাকি এমন কিছু বাস্তবতার সন্ধান লেখক পেয়েছিলেন, যা তাকে প্ররোচিত করেছিল এরকম উপন্যাস রচনায়? শোনা যায়, উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশের পর তেমন সমাদৃত হয়নি। বাস্তব বিপর্যয় ঘটার কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছিল দ্বিতীয় সংস্করণ। জনপ্রিয় না-হওয়া উপন্যাসের নামও বদলে দিয়েছিলেন লেখক। বিপর্যয়ের পর এই বইয়ের কথা উঠে আসে অনেকের মুখে। তখন কেউ কেউ মত প্রকাশ করেন যে, আগে থেকে এই কাহিনি সম্পর্কে জানা থাকলে হয়তো বাস্তবিকই বিপর্যয় এড়ানো যেত। কল্পকাহিনি হিসাবেই এ উপন্যাস অনেকের ভালো লাগেনি, জনপ্রিয়ও হয়নি।
আরও শুনুন: রাধাকৃষ্ণের দোলকে আপন করে নিয়েছিলেন নবাবরাও, হোলিতে নাচতেন স্বয়ং ওয়াজেদ আলি শাহ
কিন্তু লেখক যে কেবলই কল্পনার আশ্রয় নিয়েছিলেন তা নয়। উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে যেভাবে একজন লেখক উপাদান সংগ্রহ করেন, রবার্টসনও তাই-ই করেছিলেন। আর সেই সূত্রেই এই বাস্তবতা অনুমান করতে তাঁর সমস্যা হয়নি। সমুদ্র এবং সমুদ্রযান নিয়ে দীর্ঘদিনই কাজ করেছিলেন রবার্টসন। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন, যে আকারে-বহরে জাহাজ ক্রমশই বড় হচ্ছে। কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত সংখ্যক লাইফবোট থাকছে না। অর্থাৎ নিরাপত্তায় খামতি থেকে যাচ্ছে। পরবর্তীকালে টাইটানিক নিয়ে গবেষণা করেছেন অধ্যাপক পল হেইয়ার। তিনি লেখকের পূর্বজীবন খুঁজে স্পষ্টতই দেখিয়েছেন যে, সেই সময় জাহাজ নিয়ে যা যা সমস্যা ছিল তা সম্বন্ধে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল ছিলেন রবার্টসন। সেই বাস্তব তথ্য এবং কল্পনার ভিত্তিতেই তৈরি হয়েছিল তাঁর উপন্যাস। লেখক যা নিয়ে ভাবিত ছিলেন, বাস্তবের কর্মকর্তারা সে বিষয়গুলিকে ততটা আমল দিতে চাননি বলেই হয়তো ঘটে গিয়েছিল অতবড় বিপর্যয়। টাইটানিক ডুবে যাওয়ার পর অনেকে বলতে শুরু করেছিলেন, রবার্টসন অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতার অধিকারী। নইলে ১৪ বছর আগেই তিনি এসব কল্পনা করলেন কী করে? কিন্তু সে দৈব সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে লেখক স্বয়ং লিখেছিলেন, এর মধ্যে অতিপ্রাকৃত বলে কিছু নেই। তিনি জানেন, তিনি কী লিখেছিলেন আর কেন লিখেছিলেন।
বাস্তব আর কাহিনির বাস্তব অনেক সময়ই মিলে যায়। তবে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সঙ্গে এমন হুবহু মিলের নমুনা, বাস্তবে সত্যিই বিরল।