কেউ গিয়েছিলেন পড়াশোনা করতে। কেউ বা কাজের প্রয়োজনে। দিব্যি শান্তশিষ্ট দেশটায় হঠাৎ করেই শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। স্বাভাবিক ফেরার পথ বন্ধ। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন থেকে পালাতে তখন মরিয়া হাজার হাজার ভারতীয়। কেউ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মাইলের পর মাইল হাঁটছেন, কেউ বা প্রাণ বাঁচাতে লুকিয়ে রয়েছেন বাঙ্কারে। যে কোনও সময় রুশ হামলায় প্রাণ যেতে পারে। সে সময় ভারত সরকারের উদ্ধারকারী মিশনের অংশ হয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে গিয়েছিলেন এই কন্যা। প্রায় আড়াইশোরও বেশি পড়ুয়াকে নিরাপদে ফিরিয়ে এনেছিলেন দেশে। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? শুনব ভারতীয় পাইলট শিবানী কালরার সেই অভিযানের গল্প।
সারা পৃথিবীকে অবাক করে হঠাৎই বেজে গেল যুদ্ধের দামামা। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান ঘোষণা করে দিল রাশিয়া। সাজানো গোছানো দেশটার যুদ্ধভূমিতে পরিণত হতে বেশি দেরি লাগল না। চারপাশটা কেমন যেন থমথমে। যে কোনও সময় আকাশ থেকে নেমে আসতে পারে রুশ বোমা। আকাশে চক্কর কাটছে শত্রুদেশের বোমারু বিমান। রাস্তায় টহল দিচ্ছে রুশ সেনা।
এদিকে অসংখ্য বাসিন্দার তখন প্রতিটা মুহূর্ত তখন কাটছে তীব্র আতঙ্কে আর উৎকন্ঠায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরে আদৌ টিকে থাকতে পারবেন তাঁরা। খাবার নেই, জল নেই। মাথা বাঁচাতে সকলে আশ্রয় নিতে চাইছেন মাটির নিচে বাঙ্কারে কিংবা সাবওয়ে স্টেশনগুলিতে। ক্রমে আরও তীব্র হচ্ছে পারমানবিক হামলার আশঙ্কা। ইউক্রেনের কয়েকটি জায়গায় ভ্যাকুয়াম বোমা ব্যবহারের অভিযোগও ওঠে মস্কোর বিরুদ্ধে। ততদিনে দেশ ছাড়তে শুরু করেছে হাজার হাজার মানুষ। তার মধ্যে রয়েছে প্রবাসীরাও। যাঁরা পড়াশোনা বা কাজের প্রয়োজনে এসেছিলেন ইউক্রেনে। ভারত থেকে প্রতিবছরই হাজার হাজার ভারতীয় পড়ুয়া ইউক্রেনে যান ডাক্তারি পড়তে। কীভাবে দেশে ফিরবেন তাঁরা। আদৌ কি শেষপর্যন্ত পরিবারের কাছে ফেরা হবে তাঁদের। সেই সংশয়য়ের মধ্যেই শুরু হল ভারত সরকারের উদ্ধারকাজ।
আরও শুনুন: হাসপাতালে পৌঁছে দিচ্ছেন ওষুধ, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ইউক্রেনবাসীকে দেশ ছাড়তে সাহায্য করছেন শিখ দম্পতি
ইউক্রেনে আটকে পড়া ভারতীয়দের দেশে ফেরাতে ততদিনে অপারেশন গঙ্গা কর্মসূচী শুরু করেছে নয়াদিল্লি। তবে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের আকাশসীমা বন্ধ থাকায় উদ্ধারকাজ মোটেই সহজ ছিল না। বারবার বাধা পেতে হচ্ছিল উদ্ধারকারী দলকে। শেষমেশ প্রতিবেশী দেশগুলির মাধ্যমে আটকে থাকা ভারতীয়দের বের করে আনার ব্যবস্থা করা হয়। আর সেই মিশনেই শামিল করা হয় ভারতের নানা প্রান্তের বিভিন্ন বিমানচালক ও কর্মীদের। সেই তালিকায় নাম ছিল হরিয়ানার বাসিন্দা ক্যাপটেন শিবানী কালরার।
ওই মিশনে শামিল হওয়ার জন্য বিমানসংস্থার তরফে যখন তাঁর কাছে ফোনটা আসে, তখন দুবার ভাবেননি শিবানী। মুহূর্তে ‘হ্যাঁ’ বলে দিয়েছিলেন। এদিকে, দিন কয়েকের মধ্যেই তাঁর ভাইয়ের বিয়ে। গোটা পরিবার বিয়ের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। এই সময় মেয়ে যাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে! দুশ্চিন্তা খেয়ে ফেললেও শিবানীকে একবারের জন্যও আটকাননি তাঁর মা-বাবা। শুধু বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় শিবানীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলেন মা। বাবা-ভাইয়ের মুখেও তখন যথেষ্ট চিন্তার মেঘ। করোনার সময়েও উদ্ধারকারী মিশনের অংশ হয়েছিলেন শিবানী। সেসময় কিন্তু তাঁদের এতটা ভয় পেতে দেখেননি। সকলকে আরও বেশি আতঙ্কিত করে তুলেছিল বোধহয় যুদ্ধের খবরটাই। তবে তখন আবেগপ্রবণ হওয়ার সময় ছিল না শিবানীর কাছে। তাঁর যে কাঁধে মস্ত দায়িত্ব তখন।
আরও শুনুন: করোনা থেকে ইউক্রেনের যুদ্ধ, ভারতীয়দের উদ্ধারে বারবার বিমান উড়িয়েছেন এই বঙ্গতনয়া
যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন থেকে হাঙ্গেরি ও রোমানিয়ার এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন শয়ে শয়ে ভারতীয়। যেহেতু সোজা পথে ইউক্রেন দিয়ে ভারতীয়দের উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছিল না, তাই কূটনৈতিক ভাবে প্রতিবেশী দেশগুলির সাহায্য নেয় ভারত। ইউক্রেনের ভারতীয় দূতাবাস থেকে প্রতিবেশী দেশগুলিতে জড়ো হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল আটকে পড়া পড়ুয়াদের। সেখান থেকেই তাঁদের দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করা হয়। অপারেশন গঙ্গা মিশনের ষষ্ঠ উদ্ধারকারী বিমানের পাইলট ছিলেন শিবানী।
বুদাপেস্টে পৌঁছে যখন তাঁরা পড়ুয়াদের সঙ্গে দেখা করেন, তখন তাঁদের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। বাড়ি ফেরার জন্য আকুল প্রত্যেকেই। তাঁদেরকে আশ্বাস দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন শিবানী। অবশেষে তাঁদেরকে নিয়ে যখন দিল্লির মাটি ছুঁল বিমান, তখন হাততালিতে ভাসছে চারপাশ। পড়ুয়াদের পরিবারের লোকজন ভিড় করেছেন বিমানবন্দরে। প্রায় ২৫০ জন পড়ুয়াকে নিরাপদে বাড়ি ফিরিয়ে এনেছেন শিবানী। আর সেদিনের ওই ভিড়ে ছিলেন শিবানীর বাবা-মাও। যাঁরা চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন ‘শাবাশ শিবানী’। এমন একটা মিশনে অংশ নিতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছেন গুরুগ্রামের মেয়ে শিবানী।
দেখতে দেখতে ২০ দিনে পৌঁছেছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। চার চার বার আলোচনার টেবিলে বসেছে দু-দেশ। তবে তাতেও কোনও আলোচনাসূত্র বেরোয়নি। কবে যুদ্ধ থামবে, তার ইঙ্গিত নেই এখনও। কোনও দিনও এমন একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে গিয়ে পড়তে হবে তা ভাবেননি শিবানী। ভয় একেবারেই পাননি বললে মিথ্যে বলা হবে। যুদ্ধ, গুলি, বোমাতে কার না ভয় লাগে! তবে কর্তব্যের কাছে সেই ভয় তুচ্ছ। আবার দরকার হলে মানুষকে বাঁচাতে যুদ্ধের দেশে নির্দ্বিধায় ছুটে যাবেন তিনি, জানিয়েছেন ভারতের এই কন্যা।