সময়টা বিশ শতকের গোড়ার দিক। পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মেয়েরা চাকরি করবে, এই ছবিও তখন খুব বেশি সুলভ নয়। আর ব্যবসায় আসবে মেয়েরা? সে তো প্রায় ভাবাই যায় না। কিন্তু সেই কাজটাই করে দেখিয়েছিলেন নীলিমা গুহঠাকুরতা। বাংলা প্রকাশনার ভোল বদলে দিয়েছিলেন তিনি। আসুন, শুনে নেওয়া যাক তাঁর কথা।
বাংলায়, অর্থাৎ বঙ্গদেশে বই ছাপা শুরু হয়েছিল কবে থেকে, সে উত্তর খুঁজতে গেলে বটতলা অব্দি পৌঁছে যেতে হয়। সস্তা কাগজে যেমন তেমন করে ছাপা সেসব বই ঝুড়ি করে ফেরি করে বেড়াত বিক্রেতারা। এমনকি অন্দরমহলেও পৌঁছে যেত সেসব রোমান্স, ক্রাইম, উপকথাজাতীয় উপাখ্যান, এ কথা জানিয়েছেন ঠাকুরবাড়ির অন্তঃপুরিকারা। কিন্তু উনিশ শতকের নবজাগরণের ফলে বাংলায় শিক্ষার প্রসার ঘটল। পাশাপাশি এল পিউরিটান রুচিবোধ। ফলে বটতলার বইয়ের থেকে অন্যরকম বইয়ের চাহিদা বাড়ল। কিন্তু তখনও, বইয়ের ভিতরের মতো বইয়ের বাইরেটাও যে গুরুত্বপূর্ণ, সে কথা বাঙালি প্রকাশকেরা ভাবেননি। আর সেই কাজটাই করেছিল বিশ শতকের একটি নবীন বাংলা প্রকাশনা। যার নাম সিগনেট প্রেস। আর এই প্রকাশনা শুরু হয়েছিল দুজনের হাত ধরে, নীলিমা গুহঠাকুরতা এবং দিলীপকুমার গুপ্ত বা ডিকে। সম্পর্কে তাঁরা শাশুড়ি ও জামাই। বাংলা প্রকাশনা জগতে নতুন ঢেউ এসেছিল তাঁদের সঙ্গেই।
আরও শুনুন: প্রেমেন্দ্র মিত্রের অসমাপ্ত লেখা শেষ করার ভার নিয়েছিলেন লীলা মজুমদার
ছাপাখানা তো কতই ছিল। কিন্তু কী লক্ষ্য নিয়ে গড়ে উঠেছিল এই নতুন প্রকাশনা? সে উত্তর দিয়েছেন নীলিমা দেবী। তাঁর কথায়, সিগনেট প্রেস চেয়েছিল পাঠক তৈরি করতে। চেয়েছিল রুচি তৈরি করতে। তিনি বলেছিলেন, “ভাল লেখা ছাড়া ভাল বই হয় না— এ কথাটা হয়তো এতই স্বতঃসিদ্ধ যে বিশদ করার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এখানেও একটা কথা আছে: বইটা কী ভাবে পরিবেশন করা হবে, সেটাও জরুরি। বই তৈরি করাটাও একটা শিল্প।” সেই শিল্পের সাধনাকে এমন উৎকর্ষে পৌঁছে দিয়েছিলেন তাঁরা যে, জওহরলাল নেহরু-র ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ কিংবা বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের ‘প্রিজ়ন ডায়েরিজ’ প্রকাশ পেয়েছিল সিগনেট থেকেই। সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’, বিভূতিভূষণের ‘আম আঁটির ভেঁপু’, জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’-এর মতো নামকরা বইগুলিকে অদ্ভুত সুন্দর প্রচ্ছদ ও ছবিসহ, নির্ভুল বানানে প্রকাশ করেন তাঁরা। দামও ছিল সাধ্যের মধ্যেই।
আসলে নীলিমা কোনও দিনই ছক মেনে চলেননি। এলাহাবাদে জন্ম তাঁর। বড় হয়েছিলেন স্কটিশ গভর্নেসের কাছে, সাহেবি আদবকায়দায়। পাশাপাশি বাংলা ও সংস্কৃতের পাঠ চলত নিয়মিত। এদিকে হাল ফ্যাশনের টু-সিটার চালিয়ে দাপিয়ে বেড়াতেন শহর। লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ভূপেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল নীলিমার, কিন্তু মনের মিল হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক প্রভু গুহঠাকুরতার প্রেমে পড়ে সংসার ছাড়েন তিনি। একজন দুর্দান্ত বাগ্মী, অধ্যাপকের চাকরি ছেড়ে সাংবাদিক, সেখান থেকে বিজ্ঞাপনের জগতে এসেও সবার নজর কেড়েছেন। এদিকে জোরকদমে মৌলিক লেখা এবং অনুবাদ, প্রথম সারির সংবাদপত্রগুলিতে নিয়মিত কলাম লেখা, পাশাপাশি ছবি আঁকা চালিয়ে গিয়েছেন নীলিমা। বিজ্ঞাপনী সংস্থা ডি জে কিমারে চাকরির সূত্রেই নীলিমা ও ডিকের প্রথম পরিচয় হয়। অভিনব একটি প্রকাশনা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন ডিকে, আর এই কাজে পাশে পেয়েছিলেন নীলিমা দেবীকে।
আরও শুনুন: নতুন স্বাদের রান্নায় মুগ্ধ ভিনদেশিরা, জাপানি রেস্তরাঁর হাল ধরেছিলেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু
১৯৪৩ সালে, মাত্র ৪২ বছর বয়সে প্রভুর মৃত্যুর পরে একা হাতে সংসার সামলাতে থাকেন নীলিমা। অন্যদিকে নতুন প্রকাশনা সিগনেটেরও অধিকাংশ ভার তুলে নেন নিজের কাঁধেই। অনেকটা একা হাতেই বাংলা প্রকাশনার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। নিজস্ব লেখালিখি, সাবলীল অনুবাদ, বিস্তৃত কর্মক্ষেত্র নিয়ে বাংলা সংস্কৃতির জগতে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন তিনি, নীলিমা গুহঠাকুরতা।