একদিকে ঠাকুরবাড়ির মেয়ে। আরেকদিকে ভারতীয় সিনে-পর্দার প্রথম সম্রাজ্ঞী। বম্বে টকিজের ফার্স্ট লেডি। নিয়মভাঙার এক নাম যেন দেবিকা রানি। পুরুষের দুনিয়ায় নিজের ছন্দে চলার সাহস দেখিয়েছিলেন এই ছকভাঙা নারী। আসুন, শুনে নেওয়া যাক তাঁর কথা।
সময়টা ১৯৩৩ সাল। ভারতীয় সিনেমার তখনও শৈশব কাটেনি। আজকের দিনে যাকে ‘অ্যাডাল্ট সিন’ বলা হয়, সেইসব সাহসী দৃশ্য পর্দায় দেখানোর কথা তখন ভাবতেও পারতেন না সিনে দুনিয়ার কলাকুশলীরা। অথচ সেই যুগেই দীর্ঘ চার মিনিট ধরে একটি চুম্বনদৃশ্যে অভিনয় করেছিলেন দেবিকা রানি। ভেঙে দিয়েছিলেন সমাজনির্ধারিত ট্যাবুগুলোকে।
আরও শুনুন: ‘গাঙ্গুবাই’ আলিয়ার আগেও পর্দায় যৌনকর্মীদের ফুটিয়ে তুলেছিলেন এই নায়িকারা
হ্যাঁ, এমনই ছিলেন দেবিকা রানি। নিজের শর্তে নিজের জীবন বাঁচাটাই লক্ষ্য ছিল তাঁর। আর সেই পথে এগোনোর জন্য নিন্দেমন্দকে পাত্তা দেননি কখনোই। লেডিকিলার বলে খ্যাত চলচ্চিত্রকার, বিবাহিত হিমাংশু রায়কে বিয়ে করাই হোক; আবার সহঅভিনেতার সঙ্গে ইলোপ করাই হোক, নিজের খেয়ালখুশিতে চলেছেন তিনি। যখন অভিনয় করাকে অত্যন্ত নিচু চোখে দেখা হত, সেই সময় উচ্চশিক্ষিতা দেবিকা রানি যোগ দিয়েছেন সিনে দুনিয়ায়। হেলায় দখল করেছেন সেরার আসন। প্রথম দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের প্রাপকও তিনিই। এমনকি শোনা যায় মহাত্মা গান্ধীর দেখা একমাত্র সিনেমা নাকি ‘অচ্ছুৎ কন্যা’। যার নায়িকা সেই একজনই, দেবিকা রানি।
আরও শুনুন: স্বামী বিক্রি করে দিয়েছিল নিষিদ্ধপল্লিতে, সেই গাঙ্গুবাইয়ের জীবনই এখন সিনেমায়
ভারতের প্রথম শল্যচিকিৎসক কর্নেল মন্মথনাথ চৌধুরীর মেয়ে ছিলেন দেবিকা। বাবা ও মা, দুদিক থেকেই আত্মীয়তার যোগসূত্র ছিল খোদ ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে। পড়তে গিয়েছিলেন রবি ঠাকুরের শান্তিনিকেতনে। তাঁকে ‘সূর্যমুখীর কুঁড়ি’ বলেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, অভিভাবকদের বলেছিলেন তাঁর বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় যত্ন নিতে। সেই কথা মেনেই লন্ডনে পড়তে যান দেবিকা। আর সেখানেই হাতেখড়ি হল প্রথাগত অভিনয়ে। যদিও পেশাদার অভিনেত্রী হওয়ার বদলে টেক্সটাইল ডিজাইনিং-এর কাজকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন দেবিকা। কিন্তু তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে গেল নায়ক-প্রযোজক হিমাংশু রায়ের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর। ফিল্মে নামা আর বিয়ের প্রস্তাব এল পরপর।
হিমাংশু রায়কে বিয়ে করে ভারতে এলেন দেবিকা। যদিও অসম বয়সের এই বিয়ে সুখের হয়নি বলেই শোনা যায়। এমনকি গার্হস্থ্য হিংসার অভিযোগও করেছেন সেকালের সেরা নায়িকা। কিন্তু কোনও কিছুই তাঁর জীবনকে, তাঁর নিজের চাওয়াপাওয়াকে থামিয়ে দিতে পারেনি। প্রযোজক স্বামীর অধীনে একের পর এক জনপ্রিয় সিনেমা উপহার দিয়েছেন তিনি। আবার ইচ্ছেমতো সম্পর্কেও জড়িয়েছেন। তিরিশের কোঠাতেই বিধবা হওয়ার পর হিমাংশু রায়ের হাতে গড়া ‘বম্বে টকিজ’-এর দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। দিলীপ কুমার কিংবা মধুবালাকে দর্শকের কাছে তুলে ধরেছেন দেবিকারানিই। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নিজেকে নানাভাবে ব্যবহার করতেও কোনও দ্বিধা ছিল না তাঁর।
বারবার সমালোচনার ঝড় উঠেছে তাঁকে ঘিরে। আর তার স্বাদ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছেন দেবিকা রানি। পুরুষের হাতে খেলার পুতুল তিনি হতে চাননি, বরং নিজের পুরুষদের নিজেই বেছে নিয়েছেন তিনি। নিজের জীবনের গল্প নিজের হাতেই লিখেছিলেন বম্বে টকিজের ফার্স্ট লেডি। আর সেই কারণেই তাঁকে অপছন্দ করা যেতে পারে হয়তো, কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই।