বিয়ের বাজারে আজও পাত্রীর বিচার হয় তাঁর গায়ের রং ধরে। যেন এটাই চূড়ান্ত মাপকাঠি। ভাবতে অবাক লাগলেও এই ২০২২-এ এসেও এই ঘটনার কোনও ব্যতিক্রম দেখা যায় না। সেই ধারাবাহিকতায় দাঁড়ি টানার উদ্যোগ নিল প্রখ্যাত সংবাদপত্র ‘দৈনিক ভাস্কর’। কী পদক্ষেপ নিল এই সংবাদমাধ্যম? আসুন শুনে নিই।
পাত্রী কেমন? এই প্রশ্নের গোড়াতেই উত্তর আসবে, হয় কালো নয় ফরসা। যেন এর বাইরে কিছু হয় না। মানুষ যতই এগিয়ে যাক না কেন, আজও মানুষের সৌন্দর্যের মাপকাঠি এই ফরসা-কালো বাইনারিতেই আটকে আছে। দৃষ্টিভঙ্গির বদল নেই। আর এই সংস্কারের ভুক্তভোগী নারীরাই। কাব্যে-উপন্যাসে গৌরবর্ণা নায়িকারই আনাগোনা। পরবর্তীতে চলচ্চিত্রের মতো জনপ্রিয় মাধ্যম সেই ধারণাকেই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ নায়িকা মানেই তিনি হবেন ফরসা। সমাজজীবনে পড়েছে এর ছায়া। বিয়ের পাত্রীকে ফরসা হতেই হবে, এ যেন একেবারে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কালো রং ফরসা করার প্রসাধনীকে যে আপন করে নিয়েছেন মেয়েরা, তার নেপথ্যে থেকে গিয়েছে বহুদিনের যন্ত্রণার ইতিহাস। কালো মেয়ের সেই যন্ত্রণা নিয়ে লেখালিখি হয়েছে বিস্তর, কিন্তু বাস্তব বদলায়নি এতটুকুও। আজও বিয়ের বিজ্ঞাপনে তাই পাত্রী কালো না ফরসা, তার উল্লেখ থাকেই।
আরও শুনুন – কোলে শিশুকন্যা, ঠেলায় ক্রিকেট কিট… বিশ্বকাপের মাঠে নেমে নজির গড়লেন পাক মহিলা ক্রিকেট ক্যাপ্টেন
এই দীর্ঘকালীন অযৌক্তিক প্রথায় ইতি টানতে অভিনব পদক্ষেপ করল প্রখ্যাত সংবাদমাধ্যম ‘দৈনিক ভাস্কর’। সংস্থার পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি জারি করে জানানো হয়েছে, বর্ণ অর্থাৎ পাত্রীর গায়ের রং উল্লেখ থাকলে পাত্র-পাত্রী চাই কলামে সেই বিজ্ঞাপন এবার থেকে প্রকাশিত হবে না। নির্দিষ্ট কিছু শব্দের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। সাধারণত পাত্রীর গায়ের রং বোঝাতে ‘ফরসা’, ‘উজ্জ্বল গমের মতো বর্ণ’ এই ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয়। দৈনিক ভাস্কর-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর সুধীর আগরওয়াল জানিয়েছেন, এবার থেকে যদি বিজ্ঞাপনে এই ধরনের শব্দ ব্যবহার করে পাত্রীর গায়ের রং চিহ্নিত করা হয়, তবে কোনোভাবেই তাঁরা তাঁদের সংবাদমাধ্যমে সেই বিজ্ঞাপন প্রকাশ করবেন না। তবে শুধু এই শব্দ নয়, গায়ের রং-এর উল্লেখ থাকা বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা থেকেই বিরত থাকবেন তাঁরা। সংবাদমাধ্যমের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গায়ের রং নয়, পাত্রীর ব্যক্তিত্বই তাঁর সৌন্দর্যের পরিচায়ক। প্রত্যেকেরই আলাদা ব্যক্তিত্ব আছে। গায়ের রং দিয়ে পাত্রীকে চিহ্নিত করার মধ্যযুগীয় পন্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা। সেই সচেতনতা বাড়িয়ে তোলারই উদ্যোগ হিসাবে নেওয়া হয়েছে এই পদক্ষেপ।
আরও শুনুন: নিয়েছিলেন পুরুষের ছদ্মবেশ, পুরুষের নামও! পরিচয় লুকিয়ে প্রথম বিশ্বভ্রমণ করেছিলেন এই নারী
পাত্র-পাত্রী কলামে মহিলাদের উচ্চতা কিংবা গায়ের রং দিয়ে বিচারের প্রবণতা নিয়ে দীর্ঘদিন সমালোচনা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত এ নিয়ে গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ করতে কাউকে দেখা যায়নি। সমসময়ের প্রেক্ষিতে ভাস্কর গ্রুপের এই পদক্ষেপ তাই অত্যন্ত জরুরি। ইতোমধ্যেই তাঁদের এই সিদ্ধান্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় বহুজনের প্রশংসা কুড়িয়েছে। অনেকেই বলছেন, আমাদের মতো দেশে ফরসা পাত্রী খোঁজার প্রথা, একরকম অপরাধেরই সমগোত্র। কেননা এই প্রথা বহু মেয়ের জীবনেই যন্ত্রণা বয়ে আনে। গায়ের রং কী হবে, তা তো কারও হাতে থাকে না। অত্যন্ত স্বাভাবিক এই জিনিসটিকে কেন এমন বৈষম্যের চোখে দেখা হয়, তার উত্তর মেলে না। তবে সময় এসেছে, এবার দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর। পাঠকেরা অনেকে বলছেন, একটা অন্যরকম পৃথিবী গড়ে তোলার রাস্তায় এই পদক্ষেপ একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হয়েই থাকবে।
আরও শুনুন: প্রকাশ্যে স্তন্যদানে কীসের লজ্জা! তারকা মায়েরা ভাঙছেন সংস্কারের বেড়া
প্রসঙ্গত, কিছুদিন আগেই একটি জনপ্রিয় প্রসাধনী সংস্থা তাদের পণ্য থেকে ‘ফেয়ার’ শব্দটিকে বাতিল করেছিল। তারপরই এল সংবাদমাধ্যমের এই পদক্ষেপ। হয়তো সব সংবাদমাধ্যমই এই পথ এখনই অবলম্বন করছে না। সামগ্রিক ভাবে এই প্রথা যে এখনই অবলুপ্ত হচ্ছে তা-ও নয়। এক্ষেত্রে মনে করা যেতে পারে নীল আর্মস্ট্রং-এর সেই বিখ্যাত উক্তিটি। চাঁদে পা দিয়ে তিনি বলেছেন, মানুষের এই একটি পদক্ষেপ মানবসভ্যতার জন্য বড় অগ্রগতি। সেরকমই বর্তমানে সংবাদমাধ্যমের নেওয়া এই একটা পদক্ষেপ যে আগামীতে বড় সামাজিক পরিবর্তন আনবে না, তাই বা কে বলতে পারে! তাই দৈনিক ভাস্কর-এর এই সিদ্ধান্তকে অজস্র সাধুবাদ জানিয়েছেন পাঠক ও নেটিজেনরা।