আয়না দেখতে ভালবাসেন! তাহলে তো এখানে আপনাকে যেতেই হবে। কারণ এত বড় আয়না পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। তবে চাইলেও ঘাড়ে করে এই আয়নাকে বাড়ি বয়ে আনতে পারবেন না। প্রকৃতির খেয়ালে সেখানে প্রকট হয় এই জাদু-আয়না। ভাগ্যবানেরা তার দেখা পান। কোথায় রয়েছে এই সুবিশাল প্রাকৃতিক আয়না। শুনে নিন।
প্রকৃতি আপন মর্জির মালিক। তাই চাইলেই যে প্রকৃতির এই আয়নায় মুখ দেখতে পাবেন আপনি, এমনটা কিন্তু নয়। পৃথিবীর এই আশ্চর্য আয়নায় মুখ দেখতে পান কেবল সৌভাগ্যবানেরাই। বাকি সময় চোখের সামনেই থাকে, অথচ দেখা দেয় না সেই আয়না। এমনই আশ্চর্য খেয়াল প্রকৃতির।
সাধারণ রোদ্দুরের দিন দেখলে ছদ্মবেশে থাকে আয়না। অথচ সামান্য বৃষ্টি হলেই রূপ খোলতাই হয় তার। সকলের সামনে প্রচ্ছন্ন হয়ে ওঠে রহস্যময় সেই আয়নাভূমি। তখন সেই পুরো এলাকাটা দেখলে কাচের তৈরি বলেই ভুল হবে। আচ্ছা ব্যাপারটা তবে খোলাখুলিই বলি আপনাদের।
বলভিয়ার দক্ষিণে সালার দে ইউনি। বিশ্বের বৃহত্তম লবনাক্ত সমতলভূমি। সাধারণ সময় দেখতে অনেকটা মরুভূমির মতোই। শুধু বালির বদলে রয়েছে ধবধবে সাদা লবন। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় বারো হাজার ফুট উঁচুতে আলতিপ্লানো নামে একটি মালভূমির উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই সমতল। এই আলতিপ্লানো আবার পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মালভুমি। প্রায় ১০, ৫৮২ বর্গ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত সালার দে ইউনি সমভূমিটি রয়েছে আন্দিজ পর্বতমালার খুব কাছেই। সালার শব্দটি আদতে স্প্যানিশ, যার অর্থ নাকি লবণের সমতল। সেখান থেকেই এমন নাম।
আরও শুনুন: নড়েচড়ে, আকারে বাড়ে, করে বংশবিস্তারও! জানেন কোথায় মেলে এমন ‘জীবন্ত’ পাথর?
পৃথিবীতে এমন লবনাক্ত সমতলভূমি রয়েছে হাতে গোনা। তার মধ্যে সব চেয়ে বিশালাকার বলভিয়ার এই অঞ্চল। রোদেলা দিনে এই লবনাক্ত ভূমির উপরে একধরনের ষড়ভুজ আকৃতির দাগ দেখতে পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, বাষ্পীভূত জল থেকে লবণ স্ফটিকের আকার নেয়। আর তার ফলেই সালার দে ইউনির সারা গায়ে ওই ধরনের ষড়ভূজ আকারের দাগ তৈরি হয়। আর সেটাও বেশ দেখার মতো একটা ব্যাপার বটে। দেখে মনে হবে, কেউ যত্ন করে নকশা টেনেছে সমভূমির বুক জুড়ে। এ তো গেল রোদ্দুরের কথা।
সামান্য একটু বৃষ্টি হলেই সেখানে বেরিয়ে পড়বে বিশাল আয়না। ওই লবনাক্ত মাটিতে তখন দেখা যাবে সব কিছুর প্রতিফলন, এক্কেবারে ঝলমলে আর স্পষ্ট। মনে হবে সীমানা বলে কোথাও কিছু নেই আর।
আসলে লুন জমেই তৈরি হয়েছে ওই বিশাল সমভূমির। প্রায় চল্লিশ হাজার বছর আগে ওই এলাকায় ছিল মিনচিন নামে একটি সুবিশাল হ্রদ। তবে পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যেতে লাগল সেই প্রাগৈতিহাসিক হ্রদ। শুকিয়ে গেল তার সমস্ত জল। তার বদলে জেগে রইল সুবিশাল ওই সমভূমি। যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় আয়না বলেই পরিচিত আজ।
পাশেই রয়েছে তনুপা, কুসকু এবং কুসিনা নামে তিনটি আগ্নেয়গিরি। স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন, অনেক অনেক দিন আগে ওই নামে তিন দৈত্যাকৃতির মানুষ বাস করতেন সেখানে। কুসকু আর তনূপার বিয়ে হয়। তারপর সব ঠিকই চলছিল। গোল বাঁধে তখনই, যখন বিয়ের কিছুদিন পর কুসকু কুসিনাকে নিয়ে পালিয়ে গেল। এই কথা যখন তনুপার কানে গেল, তখন সে তার ছেলেকে দুধ পান করাচ্ছিল। স্বামীর কুকীর্তির খবর পেয়ে নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে জল ঝরতে লাগত তনূপার। দুধের সঙ্গে মিশল তাঁর সেই চোখের জল। আর তাতেই তৈরি হল সালার। যার অর্থ লবণের সমতল। স্থানীয় আয়মারা সম্প্রদায় এই দেবী তনুপাকে পুজো করেন। তাই এই লবনভূমি ‘সালার দি তনূপা’ নামে অনেক বেশি পরিচিত।
আরও শুনুন: দেওয়াল থেকে সিঁড়ি সবই তৈরি হয়েছে নুন দিয়ে! মাটির নিচে রয়েছে এই ‘ঈশ্বরের ঘর’
সৌন্দর্য তো বটেই, খনিজের দিক থেকেও বেশ সমৃদ্ধ ওই এলাকা। নুনের পাশাপাশি লিথিয়াম-সহ প্রচুর খনিজ পদার্থ মেলে এই এলাকা থেকে। বিশ্বের ৫০-৭০ শতাংশ লিথিয়ামই নাকি মজুদ রয়েছে এই এলাকায়।
সাধারণ ভাবে ডিসেম্বর থেকে মার্চ, এই সময়টাই বৃষ্টি হয় এই সালার দে ইউনিতে। বাকি সময়টা থাকে মোটামুটি শুষ্কই। তবে ওই বৃষ্টির মরসুমেই ঘটে যায় ম্যাজিক। খুলে যায় পৃথিবীর মস্ত প্রাকৃতিক ওই আয়না। সে সময় এখানে সূর্যদয় ও সূর্যাস্ত দেখার অভিজ্ঞতাটাই নাকি আলাদা। মনে হয় একই পৃথিবীতে বোধহয় দুটো সূর্য একসঙ্গে ডুবে গেল কোথায় যেন। তবে ওই যে বললাম, এমনি এমনি নয়, প্রকৃতি যদি চায় তবেই আপনি প্রত্যক্ষ করতে পারবেন এমন দৃশ্যের। আর তখন আপনিও বলতে বাধ্য হামিনাস্তু, স্বর্গ এখানেই।