পাঁচ দিন আগেই ইউক্রেনের উপর আছড়ে পড়েছে রাশিয়ার সশস্ত্র আক্রমণ। দাঁতে দাঁত চেপে এখনও প্রতিরোধ জারি রেখেছে ইউক্রেন। কিন্তু জানেন কি, এই প্রথম নয়, এর আগেও রাশিয়ার কারণেই বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল ইউক্রেন? মৃত্যুর সংখ্যা ছিল কোটি ছুঁই ছুঁই! আসুন, শুনে নেওয়া যাক ঠিক কী ঘটেছিল সেই সময়।
যেদিকে চোখ যায় ধু-ধু মাঠ। যে অঞ্চলকে বলা হত ইউরোপের শস্যের ঝুড়ি, মাথা খুঁড়ে মরলেও সেখানে শস্য মিলছে না আর। খাবারের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছে মানুষ। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। না খেতে পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়াই আপাতত নিয়তি তাদের। কারণ এ দুর্ভিক্ষ তো প্রকৃতির রোষে নয়, মানুষের জেদের বশে তৈরি। খরা হয়নি, অনাবৃষ্টি হয়নি, কোনওরকম গাছে মড়কও লাগেনি, তবুও দুর্ভিক্ষ এসেছে। এসেছে শাস্তি হিসেবে। শাসকের কথা না মানার শাস্তি।
আরও শুনুন: ‘যুদ্ধ বন্ধ করো!’ বিধ্বস্ত ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়ে ভিডিও বার্তা খুদের
হ্যাঁ, গত শতাব্দীতে এমনই ছবি দেখা গিয়েছিল ইউক্রেনে। সৌজন্যে, সেই রাশিয়া।
ব্যাপারটা খুলেই বলা যাক। সেটা বিশ শতকের তিরিশের দশক। সোভিয়েত তখনও ভেঙে যায়নি। হিসেবমতো ইউক্রেনও সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত। জারতন্ত্রকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে ক্ষমতায় এসেছে কমিউনিস্ট দল। তারা বলে, সব সম্পত্তির মালিকানা হবে রাষ্ট্রের। কেউ ধনী বা গরিব থাকবে না, সবাই একই খাবার খাবে, একরকম পোশাক পরবে। এই সূত্রেই কৃষকদের জমি ও পশুর মালিকানাও চলে এল রাষ্ট্রের হাতে। যৌথ খামার গঠনের নির্দেশ দিলেন রাষ্ট্রনেতা স্ট্যালিন। অর্থাৎ রাষ্ট্রের অধীনে একটি উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হল, শস্য রপ্তানি ও বিক্রির ভারও রাষ্ট্রের উপরেই, কৃষক কেবল নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে জমিতে দিনমজুর হিসেবে কাজ করবে।
আরও শুনুন: রাশিয়া আক্রমণ করতেই তড়িঘড়ি বিয়ে, একসঙ্গে যুদ্ধে যোগ দিলেন ইউক্রেনের নবদম্পতি
ঠান্ডা দেশ রাশিয়াতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শস্য উৎপাদক অঞ্চল ছিল ইউক্রেন। এখানকার কুলাক অর্থাৎ কৃষক সম্প্রদায় এই ব্যবস্থা মানতে চায়নি। এই মালিকানাহীন শ্রমের মধ্যে ফের ভূমিদাস প্রথার ভূত দেখেছিল তারা। সুতরাং কোমর বেঁধে তাদের শাস্তি দিতে নামলেন স্ট্যালিন। জোর করে জমি ও শস্য কেড়ে নেওয়া, সাইবেরিয়াতে নির্বাসন দেওয়া, এমনকি সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া যাতে কেউ অন্য দেশে পালাতে না পারে, সবরকমের দমননীতি প্রয়োগ করলেন তিনি।
একদিকে নানা মুনির নানা মত শুনতে গিয়ে রাষ্ট্রচালিত যৌথ খামার ব্যর্থ হচ্ছিল। আরেকদিকে কৃষকদের উপর নেমে আসা অত্যাচার। সব মিলিয়ে ইউক্রেনে দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। খিদের জ্বালায় মানুষ অখাদ্য কুখাদ্য খেতে শুরু করল। আগাছা, মল, এমনকি নরমাংস পর্যন্ত খেতে শুরু করল তারা। কালোবাজারে চড়া দামে বিক্রি হতে লাগল মানুষের মাংস। ফলে মড়ক নেমে আসতেও দেরি হল না। পরবর্তীকালে এই পরিস্থিতিকে চিহ্নিত করা হয়েছে হলোডোমর নামে। কি, নাৎসি জার্মানির সেই কুখ্যাত হলোকাস্টের কথা মনে পড়ছে তো? এই হলোডোমরও মানুষেরই তৈরি করা। মনে করা হয়, অন্তত এক কোটি লোক মারা গিয়েছিল এই সময়। বেসরকারি হিসেবে সংখ্যাটা অবশ্য আরও বেশি।
রাশিয়া অবশ্য বরাবরই এই ভয়ংকর পরিস্থিতিকে ধামাচাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা করে গিয়েছে। কিন্তু ইতিহাস কিছু ভোলে না। তাই মানুষের তৈরি করা সবচেয়ে ভয়ংকর ট্র্যাজেডিগুলির অন্যতম হয়েই রয়ে গিয়েছে হলোডোমর-এর ঘটনা।