পাহাড়ে বেড়ে ওঠা লীলা মজুমদারের। পড়াশোনা কনভেন্ট স্কুলে। কিশোরী বেলায় ঠাঁই বদল হল কলকাতায়। বাংলা ক্লাসে পিছিয়ে পড়ায় শুনতে হয়েছিল, মেম এসেছেন! সেই তিনিই বাংলা সাহিত্যের জগতে জায়গা করে নিলেন নিজের জোরে। নিজের দক্ষতা প্রমাণ করলেন এমন করেই, যে, সহযোগী লেখক খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই তাঁর কথাই মনে এল অভিজ্ঞ লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্রের। তাঁর উপরেই দিলেন নিজের অসমাপ্ত গল্প শেষ করার ভার। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
একজন তুলে ধরেছিলেন সমাজের ঘুণ ধরা ছবি। অন্যজন তার সঙ্গে জুড়ে দিলেন আলোর পথে উত্তরণের হদিশ। যা হয়ে থাকে, তার পাশাপাশি দেখালেন যা হওয়া ভাল। একজনের কলমের সঙ্গে নিজের কলম নিপুণভাবে জুড়ে দেওয়া মুখের কথা নয়। অথচ সেই কাজটাই ভারী অনায়াসে করেছিলেন তিনি, লীলা মজুমদার। তিনি উপন্যাসটি শেষ করার পরে প্রেমেন্দ্র মিত্র বলেছিলেন, “লেখার জোড় মেলাবার সূক্ষ্ম দাগটা পর্যন্ত বোঝা যায় না, এমন সহযোগী লীলা মজুমদারের মধ্যে পেয়েছি বলে আমার সগর্ব দাবি।”
আরও শুনুন: প্ল্যানচেটের অভ্যাস ছিল রবীন্দ্রনাথের, মৃত্যুর পর নাকি প্ল্যানচেটে সাড়া দিয়েছিলেন নিজেও
কী হয়েছিল ঠিক? তবে খুলেই বলা যাক।
একখানা লেখা পড়ে ছিল অসমাপ্ত অবস্থায়। সে অবশ্য বহুদিন আগের কথা। বিশ শতকের চারের দশক নাগাদ ছোটদের জন্য একটি গল্প লিখতে শুরু করেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। তখনকার সমাজের যে পচে যাওয়া, ঘুণ ধরা চেহারা তাঁর চোখে পড়ছিল, ভেবেছিলেন গল্পে তুলে আনবেন সেই ছবিটিই। এক সিঁধেল চোর রাখাল আর তার শাকরেদ ভুতো-কে নিয়ে তাই ‘হট্টমালার দেশে’ লিখতে শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু কয়েক পাতা লেখার পর আর শেষ করেননি সেই গল্প। অনেক পরে সন্দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক লেখার দাবি মেটাতে গিয়ে চোখে পড়ে অসমাপ্ত গল্পটি। এতদিন আগের লেখা, ভাবনার সুতো হারিয়ে গিয়েছে, সে কি আর ঠিকমতো গড়ে উঠবে? প্রেমেন্দ্র মিত্র ভেবেছিলেন, একজন সহযোগী লেখক থাকলে হয়তো গল্পটি সেই পরিণতি পাবে। আর সেই সূত্রেই তাঁর মনে এল লীলা মজুমদারের কথা।
আরও শুনুন: নতুন স্বাদের রান্নায় মুগ্ধ ভিনদেশিরা, জাপানি রেস্তরাঁর হাল ধরেছিলেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু
আজকের দিনে একাধিক লেখক মিলে একটি উপন্যাস লেখার কথা হামেশাই শোনা যায়। কিন্তু তখন এমন প্রবণতা বেনজির। তার উপর প্রেমেন্দ্র মিত্রের জোরালো লেখনীতে যে গল্প বোনা হয়েছে, তা শেষ করা! লীলা মজুমদার কিন্তু এমন অদ্ভুত চ্যালেঞ্জ নিতে দ্বিধা করেননি। লেখাটি যখন শেষ করলেন, তখন তা একটি উপন্যাসের আয়তনে এসে দাঁড়িয়েছে। দুই চোর, যারা অভাবের তাগিদে চুরি করে, তাদের এক আশ্চর্য দুনিয়ায় পৌঁছে দিয়েছিলেন এই দুই লেখক। যে দুনিয়ায় কারও অভাব নেই, কিন্তু যার যতটুকু প্রয়োজন সে ততটুকুই নেয়। ‘ইচ অ্যাকর্ডিং টু হিজ এবিলিটি’ থেকে সরে এসে ‘ইচ অ্যাকর্ডিং টু হিজ নিড’ স্লোগানটি জনপ্রিয় করেছিলেন কার্ল মার্ক্স। ছোটদের জন্য লেখা এই উপন্যাসেও সে কথারই ছায়া দেখেছেন সমালোচকেরা। ভারী সহজে, সাম্যবাদী সমাজের মূল কথাটুকু এই লেখায় ধরেছিলেন লীলা মজুমদার। সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের দেখেছিলেন মমতাভরা চোখে। আর খুদে পাঠকদের মধ্যে সেই চিন্তার বীজটি অনায়াসেই বুনে দিতে চেয়েছিলেন লীলা মজুমদার।