আর একটি ক্ষেত্রেও ঠাকুর তাঁর ব্যতিক্রমী চিন্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি সাধক মানুষ। আবার একই সঙ্গে তিনি পরিবারেরও অংশ। বিবাহ করেছেন। স্ত্রী আছে। এই সন্ন্যাস আর সংসারকে ঠাকুর যে সমন্বয়ে বেঁধেছিলেন তার তুলনা মেলা ভার।
ঠাকুরের দেহের ব্যাধি সেরে গেল ভৈরবী মায়ের অলৌকিক চিকিৎসায়। এবার তাঁর তত্ত্ববধানেই তন্ত্রমতে সাধনা শুরু করলেন ঠাকুর। এ বড় কঠিন সাধনার পথ। যে পথ স্থূল ইন্দ্রিয়জগত থেকে শুরু করে শেষ হয় ভাবরাজ্যের সর্বোচ্চ বিন্দুতে। তান্ত্রিক ক্রিয়ায় স্ত্রীলোকের উপস্থিতির বিধানও আছে। সাধক তাঁর ইন্দ্রিয়ানুরাগকে রূপান্তরিত করেন ঈশ্বরপ্রেমে। এ কাজ করতে ঠাকুরের অবশ্য তেমন সময় লাগল না। অন্য সাধকগণ যে পথ ধরে এগোতে এগোতে অনেক সময়ই অস্বস্তিতে পড়েন, ঠাকুর সেই পথে এগিয়ে গেলেন দ্রুত। ঠাকুরের উন্নতি দেখে বিস্মিত হলেন ভৈরবী মা। ইন্দ্রিকে উদ্দীপনা জোগায় এরকম বিষয়গুলি ঠাকুরের মন স্পর্শই করতে পারল না। এতটাই উচ্চমার্গে ছিল তাঁর অবস্থান।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২৫): ঠাকুরকে ঈশ্বরের অবতার হিসাবে চিনেছিলেন ভৈরবী মা
আমরা তো আগেই শুনেছি যে, ঠাকুর সব পথেই সাধনা করেছিলেন। তাই শুধু তন্ত্রমতে সিদ্ধিলাভ নয়। ঠাকুর বৈষ্ণব মতে সাধন করেছিলেন। অদ্বৈত সাধনাও করেছিলেন। আবার অ-হিন্দু যে পথ, সে পথেও এগিয়েছিল ঠাকুরের সাধনার ধারা। অর্থাৎ শ্রীরামকৃষ্ণ যে সমন্বয়ের মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠবেন পরবর্তীতে, তাঁর এই সাধনার পথেই ছিল সেই সমন্বয়। তাই তো তিনি বলেছিলেন, ‘যত মত তত পথ’। এই সমন্বয়ের সাধনাই তিনি দান করেছিলেন নরেন্দ্রনাথকে। নরেন্দ্রনাথ যে ঠাকুরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, তার অন্যতম কারণ হল, ঠাকুর ঠিক আর পাঁজজন সাধুর মতো ছিলেন না। বলা যায়, ঠাকুরের মতো সাধক এর আগে আসেননি।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২৪): ধ্যানের সময় ঠাকুরের শরীর থেকে বেরিয়ে গেল পাপপুরুষ
আর একটি ক্ষেত্রেও ঠাকুর তাঁর ব্যতিক্রমী চিন্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি সাধক মানুষ। আবার একই সঙ্গে তিনি পরিবারেরও অংশ। বিবাহ করেছেন। স্ত্রী আছে। এই সন্ন্যাস আর সংসারকে ঠাকুর যে সমন্বয়ে বেঁধেছিলেন তার তুলনা মেলা ভার। মা সারদার সঙ্গে ঠাকুরের বিবাহ হয় অতি অল্প বয়সে। একবার কামারপুকুরে যখন তিনি গিয়েছিলেন, সঙ্গে ছিলেন ভৈরবী মা। সারদামণি তখন চোদ্দ বছরের কিশোরী। তিনিও এসে থাকলেন স্বামীর কাছে। সেই শুরু এই দিব্য দাম্পত্যের। যেখানে কামনা বাসনার কোনও স্থান ছিল না। সারদামণিও নিজেকে সেভাবেই প্রস্তুত করেছিলেন। যদিও তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে একসময় অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠেন ভৈরবী মা স্বয়ং। ঠাকুর অবশ্য সারদামণিকে বলে দিয়েছিলেন, এ নিয়ে যেন তিনি ভৈরবী মাকে কিছু না বলেন। যেন শাশুড়িমাতার মতোই শ্রদ্ধা করেন তাঁকে। এইভাবেই এক অন্য সুরে বাঁধা ছিল ঠাকুর আর সারদামণির সম্পর্কের তার। ঠাকুর আসলে মা সারদামণির মধ্যে মা কালীকেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন। পরবর্তীকালে সে স্বীকৃতিও দিয়েছিলেন। মা যখন দক্ষিণেশ্বরে এলেন তখন কয়েক রাত তাঁরা একঘরেই ছিলেন। সেই সময়ের বর্ণনা দিয়ে মা পরে জানিয়েছিলেন, রাতভর অপূর্ব দিব্যভাবে ঠাকতেন ঠাকুর। কত কথা বলতেন, কখনও কখনও সমাধিতে চলে যেতেন। আর সেই সব দেখে ভয়ে ভয়েই থাকতেন মা। সেই ভয় টের পেয়ে একদিন ঠাকুর তাকে নহবতের ঘরে পাঠিয়ে দিলেন।
আরও শুনুন: শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২৩): বিয়ে হবে গদাধরের, পাত্রীর হদিশ দিলেন স্বয়ং পাত্র
আজীবন তাঁদের সম্পর্ক ঘিরে ছিল দিব্যভাব। ঠাকুর মাকে যেমন শ্রদ্ধা করতেন, মা-ও ঠাকুরকে কালীজ্ঞানেই শ্রদ্ধা করতেন। অর্থা দুজনই দুজনের মধ্যে মা কালীর দর্শন করেছিলেন। ঠাকুরের তিরোভাবের দিনে মা তাই কেঁদে উঠে বলেছিলেন, মা কালী কী দোষে আমায় ছেড়ে চলে গেলে! এহেন সম্পর্ক আর দুটি দেখা যায় না। সাধকের সাধারণত পরিবার থাকে না। আর যাঁরা সংসার করেন তাঁরা সংসারে জড়িয়ে থেকেই ঈশ্বরসাধনা করেন। কিন্তু ঠাকুর যেভাবে সংসার আর সন্ন্যাসকে এক সুতোয় বেঁধেছিলেন সেরকম নমুনা আর দ্বিতীয় নেই। সমন্বয়ের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ঠাকুর সেদিন তুলে ধরেছিলেন জগতের সামনে।