সভার নাম নাকি হামচূপামূহাফ! সভায় কথা চলে সাংকেতিক বাক্যে, সামনে থাকে মড়ার খুলি। আর সেই সভার সঙ্গেই যুক্ত খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! কী উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল এই সভা? আসুন, শুনে নেওয়া যাক এই গুপ্ত সমিতির কথা।
সুকুমার রায়ের ‘হ য ব র ল’ মনে আছে? যে বইয়ের শুরুতেই একটা বেড়াল স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছিল, চন্দ্রবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ, আর রুমালের মা- হল চশমা। সেইরকমই স মানে হ, ন মানে ম, বর্গীয় জ মানে চ, অ-কার মানে আসলে আ-কার, এমনই সব নিয়ম মেনে সঞ্জীবনী সভা দাঁড়াল হামচূপামূহাফ-এ। সৌজন্যে? খোদ ঠাকুরবাড়ি।
ভাবছেন, এ আবার কী সব আবোলতাবোল কথা? দাঁড়ান, তবে খুলেই বলা যাক।
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের একশো বছর পেরিয়ে গিয়েছে তখন। ১৮৫৭ সালেই সিপাহিদের ডাকে দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বিদ্রোহের আগুন। ক্রমশ পরাধীনতার জ্বালা চেপে বসছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বুকেও। বাইরের পৃথিবীতে যেসব স্বাধীনতা আন্দোলন দানা বাঁধছিল, তার আঁচ এসে লাগছিল এদের গায়ে। অস্ট্রিয়ার শাসন থেকে ইতালিকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে কার্বোনারি সম্প্রদায়ের গুপ্ত সমিতি গড়ে তোলার ঘটনা তাঁদেরও অনুপ্রাণিত করেছিল। ফলে দেশপ্রেমকে ভিত্তি করে এই সময়েই ভারতে গড়ে উঠছিল ছোট ছোট সভা। তেমনই এক গুপ্ত সভা গড়ে তুলেছিলেন ঠাকুরবাড়ির ছেলে, রবীন্দ্রনাথের নতুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিশোর রবীন্দ্রনাথকেও এই দলে টেনে নিয়েছিলেন তিনি।
আরও শুনুন: কাকা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কার্টুন এঁকেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথই জানিয়েছেন, এই সভার সমস্ত কাজই ছিল রহস্যে ঢাকা। কলকাতা শহরের এক গলির মধ্যে এক পোড়ো বাড়িতে সেই সভা বসত। একমাত্র ভাঙা টেবিলটিতে থাকত আদি-ব্রাহ্মসমাজের লাইব্রেরি থেকে আনা লাল রেশমে জড়ানো বেদমন্ত্রের একখানা পুথি। টেবিলের দুপাশে থাকত দুটি মড়ার খুলি, তার চোখের জায়গায় আবার মোমবাতি বসানো। তাঁদের মতে, মড়ার মাথাটি আসলে মৃত ভারতের প্রতীক। আর মোমবাতি জ্বালানোর অর্থ মৃত ভারতে প্রাণসঞ্চার করে তার জ্ঞানচক্ষু ফুটিয়ে তুলতে হবে। সভা শুরু হত বেদমন্ত্র গানের মধ্যে দিয়ে। নতুন কেউ সভায় দীক্ষা নিলে সেদিন অধ্যক্ষ রাজনারায়ণ বসু লাল পট্টবস্ত্র পরে আসতেন বলেও জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। ঋকমন্ত্রে দীক্ষাদান হত নতুন সদস্যদের। গভীর রাত্রে অগ্নিকুণ্ডের সামনে, বুক চিরে রক্ত দিয়ে বটপাতায় লিখে দিতে হত মন্ত্রগুপ্তির প্রতিজ্ঞা। তারপরে সেই রক্তলেখা বটপাতা পোড়ানো হত পবিত্র হোমাগ্নিতে। এই মন্ত্রগুপ্তির কারণেই বাংলা বর্ণমালার স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণের জায়গা অদলবদল করে এক সাংকেতিক ভাষা তৈরি করেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। সেই ভাষাতেই লেখা হত সভার কার্যবিবরণী। এই সভার আসল নাম সঞ্জীবনী সভা হলেও, ওই সাংকেতিক ভাষা অনুযায়ী এর নাম দাঁড়িয়েছিল হামচূপামূহাফ।
আরও শুনুন: প্ল্যানচেটের অভ্যাস ছিল রবীন্দ্রনাথের, মৃত্যুর পর নাকি প্ল্যানচেটে সাড়া দিয়েছিলেন নিজেও
দেশের উন্নতির জন্য কাজ করার উদ্দেশ্য নিয়েই এই সভার জন্ম হয়েছিল। সদস্যরা নিজেদের আয়ের দশ শতাংশ দান করতেন এখানে। সেই তহবিল দিয়ে স্বদেশী দেশলাই, স্বদেশী কাপড়, এমন নানারকম স্বদেশী কারখানা তৈরির চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সবকটিই ব্যর্থ হয়। মাত্র মাস ছয়েকের মধ্যে উঠে যায় সভাটিও। কেবল বাংলার গুপ্ত সমিতির ইতিহাসে থেকে যায় তার অদ্ভুত সাংকেতিক নাম আর অদ্ভুত কার্যকলাপের বিবরণ।