গন্ধ ব্যাপারটা যে কতটা জরুরি তা এই করোনাকাল আমাদের হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দিয়েছে। করোনার প্রথম লক্ষণই যে ছিল স্বাদ, গন্ধ চলে যাওয়া। কথায় বলে, ঘ্রাণেন অর্ধ ভোজনং। শুধু কি ভোজনের জন্য়ই গন্ধের খ্যাতি! মোটেই না। ফুল থেকে শুরু করে পারফিউম, সুগন্ধের ভক্ত তো গোটা বিশ্ব। বলা হয়, পারফিউম বা সুগন্ধী ছাড়া কোনও সাজই নাকি ঠিক মতো সম্পূর্ণ হয় না। তা এই পারফিউম বা সুগন্ধীর ব্যবহার কিন্ত আজকের নয়। শুধুমাত্র সাজগোজেই নয়, এককালে নাকি রাজনৈতিক অবস্থান বোঝানোর জন্য ব্যাবহার করা হত সুগন্ধী। কোথা থেকে শুরু হয়েছিল সুগন্ধীর জয়যাত্রা? আসুন শুনে নিই।
বিশেষজ্ঞেরা বলেন, গন্ধের সঙ্গে নাকি আমাদের স্মৃতির সরাসরি একটা যোগ আছে। কত গন্ধ যে আমাদের নস্টালজিয়ায় ভাসায়, তার কি কোনও শেষ আছে। একেকটা গন্ধ আমাদের পৌঁছে দেয় একেকটা বয়সে। তাছাড়া ভাল থাকার সঙ্গেও সুগন্ধের একটা যোগ আছে বইকি। সদ্য গিয়েছে ভ্যালেন্টাইনস ডে। ভ্যালেন্টাইনস ডে-র পরেই ইদানীং অ্যান্টি ভ্যালেন্টাইনস উইক পালনের চল হয়েছে। সেই সপ্তাহে ইতিমধ্যেই ঢুকে পড়েছি আমরা। সেই হিসেবে ১৭ ফেব্রুয়ারি নাকি পারফিউম ডে। তা এই পারফিউম বা সুগন্ধীর শুরুটা কোথায় হয়েছিল জানেন? আসুন, ফিরে দেখি, সুগন্ধী তৈরির সেই ইতিহাস।
প্রথম সুগন্ধী তৈরিতে হাত পাকিয়েছিল নাকি প্রাচীন মিশর সভ্যতা। সেখান থেকে সেই ধারা পোঁছয় সিন্ধু সভ্যতা ও প্রাচীন চিনে। পরে রোমান ও মুসলিমদের হাত ধরে আরও উন্নত হয় এই পারফিউম।
মিশরীয়রা নাকি এই পারফিউম বা সুগন্ধী ব্যবহার করতেন প্রায় সব জায়গাতেই। রোজের পোশাকআশাক থেকে শুরু করে ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সুগন্ধীর ব্যবহার ছিল বাধ্যতামূলক। সুগন্ধ দিয়ে বোঝানো হত সামাজিক অবস্থান। যেমন ধরুন, যাঁরা সমাজে একটু অভিজাত, তাঁরা ব্যবহার করতেন লিলি ফুলের সুবাস। মজার কথা হল, প্রাচীন মিশরে রাজনৈতিক অবস্থানও নাকি চেনানো হত এই সুগন্ধী ব্যবহার করেই। হ্যাঁ, এখন যেমন রাজনীতির আলাদা আলাদা রং হয়, সে সময় রাজনীতির আলাদা আলাদা গন্ধ পাওয়া যেত।
আরও শুনুন: দু-দিনেই শুকিয়ে যাচ্ছে ফুলদানির ফুল! কীভাবে ধরে রাখবেন তার তরতাজা ভাব?
মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় তাপ্পুতি নামে এক মহিলা বিজ্ঞানী ছিলেন। খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ বছর আগে তিনিই নাকি প্রথম সুগন্ধ নিষ্কাশনের প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছিলেন। চরক সংহিতা ও সুশ্রুত সংহিতাতে ইত্তর বা আতর শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। পৃথিবীর সব চেয়ে প্রাচীন সুগন্ধীটি মিলেছিল সাইপ্রাস দ্বীপ থেকে। ইতালির এক দল পুরাতাত্বিক প্রমাণ পেয়েছিলেন, সেখানে এককালে ছিল সুগন্ধী তৈরির কারখানা। সেটা অবশ্য প্রায় চার হাজার বছর আগে ব্রোঞ্জ যুগের ঘটনা। প্রায় চার হাজার বর্গ মিটার জায়গা জুড়ে ছিল সেই কারখানা, যেখানে রীতিমতো বাণিজ্যিক ভাবে সুগন্ধী তৈরি হত বলে জানা গিয়েছে। পবিত্র সুগন্ধীর উল্লেখ রয়েছে বাইবেলেও। তবে সেই ঐশ্বরিক সুগন্ধ অবশ্য সকলের ব্যবহারের জন্য নয়।
গ্রীক ও রোমানদের হাত ধরে অনেকটাই বদলে গেল এই পারফিউম ব্যাপারটা। অনেক বেশি পরিমাণে তৈরি হতে লাগল এই সুগন্ধী। কোন সুগন্ধীতে কোন উপাদান ঠিক কতটা পরিমাণে থাকবে, রীতিমতো সে সব নিয়ে অঙ্ক কষে তৈরি হতে শুরু করল পারফিউম। পারফিউম নিয়ে শৌখিন ছিল ইসলামিক সংস্কৃতিও। মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে আরও পরিণত হল সুগন্ধী তৈরির প্রক্রিয়া। স্টিম ডিস্টিলেশনের মাধ্যমে সুগন্ধ নিষ্কাশনের নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন তাঁরা। পাশাপাশি নানা ধরনের নতুন রকমের উপাদান ব্যবহার করাও শুরু হল তাঁদের হাত ধরে। ধর্মীয় রীতি হিসেবেও সুগন্ধী ব্যবহার করতেন তাঁরা।
আরও শুনুন: ফুলেরও আছে নিজস্ব ভাষা, লাল গোলাপ কেন ভালবাসার কথা বলে জানেন?
আরবের হাত ধরেই চতুর্দশ শতাব্দীতে পারফিউমের চর্চা ঢুকে পড়ল ইউরোপে। প্রথম আধুনিক পারফিউম কিন্তু তৈরি হয়েছিল হাঙ্গেরিতে। সুগন্ধী তেলের সঙ্গে অ্যালকোহল মিশিয়ে তৈরি হয়েছিল সেই পারফিউম। যেমনটা আজকাল হয় আর কি! রানি এলিজাবেথের নির্দেশে ১৩৭০ সালের পর থেকে ইউরোপে সেই সুগন্ধী পরিচিত হল ‘হাঙ্গারি ওয়াটার’ নামে। রানি এলিজাবেথ নাকি বাজে গন্ধ একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। তাই যে কোনও রকমের পাবলিক প্লেসে সুগন্ধী ছড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তাঁর জমানায়।
তবে কম দিনের মধ্যেই ফ্রান্স হয়ে উঠল পারফিউম তৈরির পীঠস্থান। ১৭ শতকের দিকে দারুণ সাফল্যের মুখ দেখে এই পারফিউম শিল্প। ১৬৫৬ সালের মাঝামাঝি সুগন্ধী দস্তানা খুব জনপ্রিয় হয়েছিল ফ্রান্সে। তবে জানেন, বেশ কিছু সুগন্ধী তৈরির সংস্থা কিন্তু তলে তলে তৈরি করত সুগন্ধী-বিষও। সে সময়কার এক ফরাসি রানিকে খুন করা হয়েছিল সেই সুগন্ধীবিষ দিয়েই। মনের সুখে সুগন্ধীখানা নিয়ে দস্তানায় ঘষেছিলেন তিনি। সেই বিষ কিছুক্ষণের মধ্যেই শরীরে ঢোকে আর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন রানি। সে যাই হোক, আজও সব চেয়ে নামীদামী পারফিউম কিন্তু মেলে এই প্যারিসেই।
সুগন্ধী তৈরির পিছনে যে দেশেরই অবদান থাকুক না কেন, পরবর্তীকালে গোটা বিশ্ব জুড়েই দারুণ জনপ্রিয় হয়েছে এই বিশেষ সাজের সরঞ্জামটি। সমস্ত অনুষ্ঠানে মানানসই সাজের সঙ্গে মানানসই গন্ধের কদর কিন্তু নেহাতই কম নয়। শুধু পারফিউমই নয়, ডিও থেকে কোলন, এখন তো নানা নামে নানা ধরনের সুগন্ধী পাওয়া যায় বাজারে। পারফিউম ডে-তে বরং বেছে নিন আপনার পছন্দসই সেই সুগন্ধ।