একদিন দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়ির বকুলতলা স্নানের ঘাটে এসে দাঁড়াল যাত্রীবাহী একখানা নৌকা। আর সেই নৌকা থেকে নেমে এলেন এক রমণী। বছর চল্লিশ বয়স তাঁর। তিনি পরিব্রাজিকা। ভৈরবী, তান্ত্রিক সন্ন্যাসিনী। সাধন বিষয়ক ক্রিয়াকাণ্ডে তিনি অভিজ্ঞ। তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন একজনকে। ঈশ্বরের আদেশেই যেন খুঁজছিলেন সেই ব্যক্তিকে, যাঁকে তিনি ধর্ম সাধনায় সহায়তা করতে পারবেন। সেই তিনি এলেন দক্ষিণেশ্বরেই।
যুবক নরেন্দ্রনাথ যখন আধ্যাত্মিক জগতে নিজের পথ খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, তখন অকূল সমুদ্রে নাবিক হয়ে তাঁর পাশে এসেছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। নরেন্দ্রনাথ শাস্ত্র পড়েছেন খুঁটিয়ে। এদিকে যুক্তিবাদী মন তাঁর। দেশ ও সমাজের সেই সময়কার অবস্থা তাঁকে বেশ ভাবিয়েই তুলেছিল। একদিক থেকে ধর্মীয় গোঁড়ামি ভাঙার চেষ্টা হচ্ছিল। আবার সেই চেষ্টার দরুণ বহু সনাতন ধারণাকে অস্বীকারের প্রবণতাও বাড়ছিল। যা একটা জাতির জন্য সুখকর হতে পারে না। আবার পরাধীন দেশের জনগণের সেই সময়ে জেগে ওঠাও একান্ত কাম্য ছিল। সব মিলিয়ে পথ যে ঠিক কোনটা, তা নিয়ে খানিক দ্বিধান্বিতই ছিলেন নরেন্দ্রনাথ। ব্রাহ্ম আদর্শকে অনেকটাই আপন মনে করেছিলেন তিনি। কিন্তু সেখানকার প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মকানুনকে যে খুব মন থেকে গ্রহণ করতে পেরেছিলেন তা নয়। এমত অবস্থায় ঠাকুরের সান্নিধ্য যেন তাঁকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছিল।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২৪): ধ্যানের সময় ঠাকুরের শরীর থেকে বেরিয়ে গেল পাপপুরুষ
একই ভাবে ঠাকুর রামকৃষ্ণও তাঁর তরুণ বয়সে এরকমই আশ্রয় পেয়েছিলেন। আমরা আগেই জেনেছি যে, বিবাহের পর দক্ষিণেশ্বরে ফিরে ঠাকুর কঠোর তপস্যার রত হয়েছিলেন। তার ক্লেশ পড়ছিল তাঁর শরীরে। শরীরের বিন্দুমাত্র যত্ন নেওয়ার দিকে তাঁর হুঁশ থাকত না। এক একসময় নিজেই নিজেকে দেখে চমকে উঠতেন। ভাবতেন, তিনি কি উন্মাদ হয়ে গিয়েছেন! সেই সময়কার অবস্থা জানিয়ে ঠাকুর বলেছিলেন, প্রায় ছয় বছর তাঁর চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম ছিল না। এমনকী চেষ্টা করেও চোখের পলক ফেলতে পারতেন না। খুব স্বাভাবিক ভাবেই শরীর একেবারে ভেঙে পড়েছিল। সকলেই বুঝতে পারছিলেন, এই অবস্থা চললে ঠাকুরকে বাঁচানো কঠিন হবে। কিন্তু তাঁর অসুখটা যে কী, তাই-ই তো কেউ বুঝে উঠতে পারেন না। আবার ডাকা হল চিকিৎসককে। তিনি তাঁর মতো করে চিকিৎসা করলেন বটে। কিন্তু এবারও কাজের কাজ কিছু হল না।
আরও শুনুন: শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২৩): বিয়ে হবে গদাধরের, পাত্রীর হদিশ দিলেন স্বয়ং পাত্র
আসলে উচ্চ আথ্যাত্মিক মার্গে তখন ঠাকুরের অবস্থান। সেই কারণেই তাঁর শরীরে ফুটে উঠেছিল বিভিন্ন চিহ্ন। যার নিরাময় কোনও ডাক্তারের দ্বারা সম্ভব ছিল না। ঠাকুর মায়ের কাছে কেঁদে বলতেন, তোকে ডাকার এই কি ফল হল? শরীরে বিষম ব্যাধি দিলি! আবার পরক্ষণেই বলে উঠতেন, তা যা হবার তা হোক, শরীর যায় যাক, তুই কিন্তু আমায় ছাড়িস নি… আমি যে মা তোর পাদপদ্মে একান্ত শরণ নিয়েছি, তুই ভিন্ন আমার যে আর অন্য গতি একেবারেই নেই।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২২): মা কালীর পাশাপাশি মা সীতারও দর্শন পেয়েছিলেন ঠাকুর
একদিন দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়ির বকুলতলা স্নানের ঘাটে এসে দাঁড়াল যাত্রীবাহী একখানা নৌকা। আর সেই নৌকা থেকে নেমে এলেন এক রমণী। বছর চল্লিশ বয়স তাঁর। তিনি পরিব্রাজিকা। ভৈরবী, তান্ত্রিক সন্ন্যাসিনী। সাধন বিষয়ক ক্রিয়াকাণ্ডে তিনি অভিজ্ঞ। তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন একজনকে। ঈশ্বরের আদেশেই যেন খুঁজছিলেন সেই ব্যক্তিকে, যাঁকে তিনি ধর্ম সাধনায় সহায়তা করতে পারবেন। সেই তিনি এলেন দক্ষিণেশ্বরেই। একে কি কাকতালীয় ঘটনা বলা যায়, নাকি এ মা কালীরই ইচ্ছা – সে বিচার করে কাজ নেই। এঁর কাছেই সেই অসহায় অবস্থায় আশ্রয় পেয়েছিলেন ঠাকুর। রামকৃষ্ণকে দেখেই তিনি বুঝেছিলেন, এই ব্যক্তিরই সন্ধান করছিলেন তিনি।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২১): ঠাকুরের আশ্চর্য ক্ষমতার পরিচয় পেয়েছিলেন রানি রাসমণি
ঠাকুরের শারীরিক বিকারের গল্প শুনে তিনি বুঝলেন, রামকৃষ্ণ ভগবদপ্রেমের চরম অবস্থায়, মহাভাবে অবস্থান করছেন। তার ফলেই শরীরের এই যন্ত্রণা। শাস্ত্র ও ভাষ্যে শ্রীরাধিকা এবং শ্রীচৈতন্যের ভাবাবস্থা সম্পর্কে এরকমই লেখা আছে। তাই-ই হয়েছে রামকৃষ্ণের ক্ষেত্রেও। তিনি বুঝলেন, এ কেবল শারীরিক ব্যাধি নয়। এর প্রতিকারও তাই আলাদা পথেই হবে। তার নির্দেশও শাস্ত্রে আছে। তিনি ঠাকুরের গলায় পরিয়ে দিলেন সুরভী পুষ্পের মালা। অঙ্গে লেপন করলেন চন্দন। আর কী আশ্চর্য! ঠাকুরের এতদিনের প্রবল গাত্রদাহ যেন ইন্দ্রজালের মতোই উবে গেল। ভৈরবী মা আবারও বুঝলেন, তিনি রত্ন চিনেছেন। ঠাকুর একটু সুস্থ হলে তিনি দক্ষিণেশ্বরে একটা সভার আয়োজন করলেন। সেখানে এলেন বৈষ্ণব ও তন্ত্রশাস্ত্রবিদ পণ্ডিতরা। তাঁদের সামনে শ্রীরামকৃষ্ণের অবস্থা ব্যাখায় করে, শাস্ত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন তিনি। অকাট্যভাবে প্রমাণ করে দিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ ঈশ্বরেরই অবতার। সকলে দ্বিধাহীন ভাবে সেদিন তাঁর কথা মেনেও নিয়েছিলেন। যাঁরা এতদিন ঠাকুরের আচরণকে পাগলামি ভেবেছিলেন, তাঁরা বিস্মিত হলেন। কালীবাড়ির সকলে তাকে এবার দেখলেন সম্ভ্রম, সমীহের চোখে। অবশ্য ঠাকুরের এতে বিশেষ হেলদোল না। তিনি মায়ের শিশুর মতোই সরল থেকে গেলেন। সেই ভাব তিনি ধরে রেখেছিলেন আজীবন।