একদিন ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। দেখলেন, এক অতিকায় ভীষণ পুরুষ তাঁর শরীর থেকে বেরিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলেন সেই নবীন সন্ন্যাসীপুরুষও। তিনি সেই অতিকায় পুরুষের পিছু নিলেন। তারপর তাঁকে ত্রিশূলের আঘাতে হত্যা করে পুনরায় ঠাকুরের দেহে প্রবেশ করলেন।
ঠাকুরের হদিশ দেওয়া পাত্রীর সঙ্গেই বিয়ে হয়ে গেল তাঁর। কিন্তু তাতে অবশ্য তাঁর সাধনা ব্যাহত হল না। বেশ কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে কাটিয়ে ঠাকুর ফিরে এলেন দক্ষিণেশ্বরে। আবার গ্রহণ করলেন মা কালীর পূজার ভার। এইবার যেন নিজের সাধনা নিয়ে আরও সচেতন ঠাকুর। নানাভাবে নিজেকে পরীক্ষা করে দেখে নিচ্ছেন দক্ষিণেশ্বরের মাটিতে। এই তো তাঁর সাধনার ভূমি। উত্তরকালে যে সমন্বয়ের বার্তা তিনি দেবেন, মন্দির চত্বরই যেন সেই পটভূমি রচনা করে দিয়েছিল। একদিকে মা কালীর মন্দির। অন্যদিকে সারিসারি শিব মন্দির। তার পাশেই হচ্ছে রাধাগোবিন্দের নিত্য সেবা। নানা মতের মিলনক্ষেত্র যেন তৈরি হয়েই ছিল। আর সেখানেই সাধনপথের নানা স্রোত অবলম্বন করে ঠাকুর নিজেকে ক্রমাগত পরখ করে নিচ্ছিলেন। আমরা আগেই জেনেছি যে, ঠাকুরের সাধনার ধারা ছিল বেশ আলাদা রকম। কীরকম সেই পদ্ধতি, আজ তাই শুনে নেব।
আরও শুনুন: শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২৩): বিয়ে হবে গদাধরের, পাত্রীর হদিশ দিলেন স্বয়ং পাত্র
দক্ষিণেশ্বরে আসার পর ঠাকুর তাঁর তপস্যার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিলেন। তাঁর আত্মা যেন ঈশ্বরসঙ্গ লাভের জন্য ক্ষুধিত। মাসের পর মাস শরীরের কোনও যত্ন নেন না। মাথার চুল জটা হয়ে যায়। নিশ্চল হয়ে যখন তিনি ধ্যান করতেন, কাকপক্ষীতেও টের পেত না যে, তিনি জীবিত মানুষ। তাঁকে জড়বৎ ভেবে নিয়ে তাঁর গায়ে এসে বসত পাখি। খাবারের সন্ধানে ঠোঁট দিয়ে জটা ঠুকরে দিত। কিন্তু ঠাকুরের তাতে কোনও বিচলন নেই। তিনি তাঁর ধ্যানে অটল। এইরকম ধ্যানের সময় মাঝেমধ্যেই তাঁর অদ্ভুত দর্শন হত। দেখতেন, তাঁরই মতো এক নবীন সন্ন্যাসী তাঁরই শরীর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তাঁকে নানা উপদেশ দিলেন। তারপর আবার শরীরের ভিতর ঢুকে গেলেন। একদিন ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। দেখলেন, এক অতিকায় ভীষণ পুরুষ তাঁর শরীর থেকে বেরিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলেন সেই নবীন সন্ন্যাসীপুরুষও। তিনি সেই অতিকায় পুরুষের পিছু নিলেন। তারপর তাঁকে ত্রিশূলের আঘাতে হত্যা করে পুনরায় ঠাকুরের দেহে প্রবেশ করলেন। ঠাকুর বুঝলেন, ওই অতিকায় ব্যক্তিই হল পাপপুরুষ। তাঁর ভিতরের সন্ন্যাসীপুরুষ সেই পাপপুরুষকে হত্যা করল।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২২): মা কালীর পাশাপাশি মা সীতারও দর্শন পেয়েছিলেন ঠাকুর
এই ঘটনার সঙ্গে আমরা নরেন্দ্রনাথের উপলব্ধিও মিলিয়ে দেখতে পারি। একদিন নরেন্দ্রনাথও বলেছিলেন, ঠাকুর শরীরের ভিতর থেকে তাঁকে দক্ষিণেশ্বরে টেনে নিয়ে যান। সারা রাত অনেক উপদেশ দিয়ে তবেই ফিরতে দেন। গুরু এবং শিষ্যের জীবনকে এইভাবে পাশাপাশি দেখলে আমরা সাধনার ধারাটি চিনতে পারি।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২১): ঠাকুরের আশ্চর্য ক্ষমতার পরিচয় পেয়েছিলেন রানি রাসমণি
আরও নানাভাবে ঠাকুর নিজেকে পরীক্ষা করে নিয়েছিলেন সেই সময়। কাঞ্চনে আসক্তি যাতে না থাকে, তার জন্য একটি অদ্ভুত উপায় বের করেছিলেন। এক হাতে মাটি আর অন্য হাতে টাকা নিয়ে তিনি বিচার করতেন। নিজেকে বোঝাতেন, মাটির থেকে টাকার শ্রেষ্ঠতা কিছু নেই। অনেক সময় দুটোকেই বিসর্জন দিতেন গঙ্গায়। যতক্ষণ না কাঞ্চনত্যাগ পূর্ণাঙ্গ হয়েছে, ততক্ষণ এই কাজ চলত। নিজেকে এই জায়গায় উত্তীর্ণ করে তবেই তো ঠাকুর বলেছিলেন সেই যুগোত্তীর্ণ কথাখানা – টাকা মাটি, মাটি টাকা।
আমরা আগে শুনেছি যে, ঠাকুরে মধ্যে পুরনো সংস্কার কিছু ছিল। গোড়ার দিকে তিনি মন্দিরের খাবার খেতেন না। সেই ঠাকুরের অন্তর যখন ঈশ্বরের ভাবে পূর্ণ তখন তিনি জাতের বিচার ত্যাগ করলেন। আমি অন্যের চেয়ে বড় – এহেন সকল ভাব তিনি মন থেকে সরিয়ে দিলেন। একসময় মেথরদের সঙ্গে স্বহস্তে তিনি মল পরিষ্কারও করেছেন। এইরকমই অভিনব ছিল ঠাকুরের সাধনার ধারা। শুধু ধারণার বশে, বা অন্য কারোর কথা শুনে তিনি কোনও কিছু ত্যাগ বা গ্রহণ করেননি। নিজের জীবন দিয়ে সমস্তই পরীক্ষা করে নিয়েছিলেন। ঈশ্বরকে তিনি সত্যিই দর্শন করেছিলেন বলেই, পরবর্তীতে নরেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন সে কথা। বলেছিলেন, তোকে যেমন দেখতে পাই, তেমন স্পষ্ট করেই আমি তাঁকে দেখেছি।
এই সাধনার ধারাই তিনি সমর্পণ করেছিলেন নরেন্দ্রনাথকে।