বিক্রি আছে! তা-ও আবার কী? না, তাজমহল। অবাক হচ্ছেন তো? কিন্তু সেই তাজমহলকেই বিদেশিদের কাছে বিক্রি করে টাকা কামিয়েছেন এই ব্যক্তি। শুধু কি একবার! কম করে তিনবার একই তাজমহল আলাদা আলাদা লোকের কাছে বেচে দিয়েছেন। ভারতের সেরা প্রতারকদের মধ্যে তিনি অন্যতম। শুনে নিন সেই কুখ্যাত নটবরলালের কথা।
‘বান্টি অওর বাবলি’ কিংবা ‘স্পেশাল 26’-এর মতো সিনেমা দেখে চমকে উঠি আমরা। কিন্তু কোথায় লাগে সিনেমা! এ দেশেই রয়েছে এমন কিছু প্রতারণার গল্প, যা চমকে দেবে সিনেমাকেও।
পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের এক আশ্চর্য তাজমহল। তা সেই তাজমহলকেই বেচে দিয়েছিলেন এক ভারতীয়। একবার দুবার নয়, মোট তিন বার বিদেশিদের কাছে বেচেছেন একই তাজমহল। শুধু কি তাজমহল, লালকেল্লা, রাষ্ট্রপতি ভবন, এমনকি একবার গোটা সংসদভবনটাও বিক্রি করে দিয়েছিলেন তিনি। তা-ও আবার ৫৪৫ জন সদস্য-সহ।
গল্পের মত মনে হলেও সমস্তটাই কিন্তু এক্কেবারে সত্যি ঘটনা। আর এ সবের পিছনেই মূল মাথা ছিলেন নটবরলাল নামে এক ব্যক্তি। যাঁকে ভারতের অন্যতম কুখ্যাত প্রতারক বললেও ভুল হবে না। বেশ কয়েকটি সিনেমাও হয়েছে তাঁকে নিয়ে। বলিউডে অন্তত দুটো সিনেমার কথা বলা যায়, যা তৈরি হয়েছে নটবরলালের জীবনের উপরে ভিত্তি করে। একটিতে অভিনয় করেছিলেন অমিতাভ বচ্চন, অন্যটিতে ইমরান হাসমি। ‘মিস্টার নটবরলাল’ এবং ‘রাজা নটবরলাল’- বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল দুটি সিনেমাই।
এই কুখ্যাত নটবরলালের গল্পই শোনাব আজ। বিহারের সিওয়ান জেলার বাঙরা নামে একটি গ্রামে জন্মেছিলেন এই নটবরলাল। না, নটবর তাঁর ভাল নাম নয় মোটেই। বাবা-মা নাম রেখেছিলেন মিথিলেশ কুমার শ্রীবাস্তব। তবে কম করে পঞ্চাশ খানা ছদ্মনাম ছিল তাঁর। লোক ঠকাতে কখন কোনটা কাজে লাগে, কে বলতে পারে। প্রতারণার ব্যবসা শুরু করার আগে নটবরলাল ছিলেন পেশায় উকিল। শুধু বিদেশিদেরই নয়, এ দেশের বড় বড় শিল্পপতিদেরও বেশ কয়েকবার ঠকিয়েছেন নটবরলাল। সমাজকর্মী সেজে তাঁদের থেকে হাতিয়েছেন বড় অঙ্কের টাকা।
আরও শুনুন: সময় কাটছে না, সাড়ে সাত কোটির পেন্টিংয়ে পেন দিয়ে চোখ আঁকলেন নিরাপত্তারক্ষী
লোক ঠকানোর মতো অনেক গুণই আয়ত্ত করেছিলেন নটবরলাল। সই জাল করার ব্যাপারে তাঁর মতো দক্ষ লোক কমই ছিল দুনিয়ায়। বহু বড় মানুষের সই জাল করে তাঁদের প্রতারণা করেছেন নটবরলাল। তবে এ সব চুটোপুঁটির কাজ বেশিদিন ভাল লাগেনি তাঁর। স্থির করলেন, এ বার দেশের ঐতিহাসিক জায়গাগুলো নিয়েই প্রতারণা করবেন। আর তার জন্য তাজমহলের চেয়ে ভাল কীই বা হতে পারত বলুন! যেমন ভাবা তেমনি কাজ। সরকারি আধিকারিক সেজে বিদেশিদের কাছে তাজমহল বেচার প্রস্তাব রাখলেন নটবরলাল। সফলও হলেন। একবার নয়, অন্তত তিন বার একই তাজমহল বিভিন্ন লোকের কাছে সফল ভাবে বিক্রি করে ফেললেন ধুরন্ধর নটবরলাল।
দেশের আটটি রাজ্য জুড়ে শতাধিক মামলা ছিল নটবরলালের বিরুদ্ধে। সব মিলিয়ে অন্তত ১১৩ বছর জেল খাটার কথা ছিল তাঁর। তবে তেমনটা বাস্তবে ঘটেনি। খুব বেশি হলে ২০ বছর জেল খেটেছেন তিনি। সারা জীবনে মোট ৯ বার গ্রেফতার হয়েছেন। তবে প্রতিবারই দক্ষ ভাবে জেল থেকে পালিয়ে গিয়েছেন নটবরলাল। একবার তো এক পুলিশ অফিসারের পোশাক চুরি করে সেটা পরেই সবার সামনে দিয়ে জেল পালিয়েছিলেন নটবরলাল। থানার কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি ব্যাপারখানা। ১৯৯৬ সালে শেষবার গ্রেফতার হন নটবর। তখন তাঁর বয়স প্রায় ৮৬। সেই বয়সেই জেল পালিয়েছিলেন তিনি। কানপুর জেল থেকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার সময় পুলিশের চোখে ধুলো দেন নটবরলাল।
তবেই ভাবুন, প্রতারণার ব্যাপারে কতখানি দক্ষ ছিলেন এই ব্যক্তি। ১৯৯৬ সালে জেল থেকে পালানোর সময় দিল্লি রেলস্টেশনে শেষবার দেখা গিয়েছিল তাঁকে। তার পরে আর কেউ কখনও নটবরলালের খোঁজ পায়নি। জীবনের মতোই তাঁর মৃত্যুটাও রহস্যে ঢাকা। তাঁর উকিল দাবি করেন, ২০০৯ সালের ২৫ জুলাই মারা যান নটবরলাল। এদিকে তাঁর ভাই গঙ্গাপ্রসাদ শ্রীবাস্তব জানান, ১৯৯৬ সালে রাঁচীতেই নটবরলালের শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছিলেন তিনি। সেই রহস্যের কিনারা হয়নি আজও।
আরও শুনুন: দুর্ধষ গুপ্তচর আবার তিনি গান্ধী অনুগামীও… সিনেমাকেও হার মানায় এই সাহসিনীর জীবন
আইনের চোখে নটবরলাল একজন কুখ্যাত প্রতারক। অথচ তাঁর গ্রামে তাঁর খ্যাতি রবিন হুডের মতোই। সারা জীবন ধরে লোক ঠকিয়ে যা উপার্জন করেছিলেন নটবরলাল, তার অনেকটাই তিনি ব্যায় করেছেন গরিব মানুষের প্রয়োজনে। ওই গ্রামটিতে তাঁর এতটাই জনপ্রিয়তা ছিল, যে গ্রামবাসীরা নটবরলালের মূর্তি পর্যন্ত তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তবে শেষপর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি। একদিকে দুর্ধর্ষ ভাবে প্রতারণা, লোক ঠকানো, অন্যদিকে গরিবের প্রয়োজনে নিজের সমস্ত কিছু দান করে দেওয়া, সবটা মিলিয়ে আশ্চর্য চরিত্র ছিল এই নটবরলাল। যার কীর্তি আজও অবাক করে মানুষকে।