মায়ের পুজো যখন তিনি করতেন, তখন তা যেন আর ধরাবাঁধা নিত্যকর্মবিধিতে আটকে থাকল না। মাতৃমূর্তি তখন আর কেবল পাষাণ-কায়া হয়ে তাঁর কাছে আর থাকল না। তিনি হয়ে উঠলেন চিন্ময়ী মা। ঠাকুর মায়ের মূর্তির নাকের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে দেখতেন, অবিকল মানুষের মতোই নিঃশ্বাস টের পাচ্ছেন। রাত্রে তন্নতন্ন করে খোঁজেন। কিন্তু মায়ের মূর্তির কোনও ছায়া তিনি দেখতে পান না।
দিব্যদর্শন হওয়ার পর থেকেই ঠাকুরের অন্তর এল বদল। যে সব পুরনো সংস্কারে বিশ্বাস রাখতেন তিনি, আসতে আসতে সে সব থেকে সরে এলেন। তাঁর অন্তর তখন এমন ভাবে পূর্ণ, সেখানে এই পার্থিব নিয়মকানুন, সংস্কার-গণ্ডির কোনও জায়গা ছিল না। সব যেন ভেসে যেতে থাকল কুটোর মতো।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১৯): কবরস্থানে বসেও মা ভবতারিণীর ধ্যান করেছিলেন ঠাকুর
এর প্রভাব পড়ল তাঁর পুজো পদ্ধতিতেও। মায়ের পুজো যখন তিনি করতেন, তখন তা যেন আর ধরাবাঁধা নিত্যকর্মবিধিতে আটকে থাকল না। মাতৃমূর্তি তখন আর কেবল পাষাণ-কায়া হয়ে তাঁর কাছে আর থাকল না। তিনি হয়ে উঠলেন চিন্ময়ী মা। ঠাকুর মায়ের মূর্তির নাকের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে দেখতেন, অবিকল মানুষের মতোই নিঃশ্বাস টের পাচ্ছেন। রাত্রে তন্নতন্ন করে খোঁজেন। কিন্তু মায়ের মূর্তির কোনও ছায়া তিনি দেখতে পান না। সব কাজ সেরে হয়তো শুয়েছেন। হঠাৎ শুনতে পেলেন মায়ের পায়ের নূপুরের শব্দ। মা যেন বালিকার মতোই হাঁটছেন। ঠাকুর কম্পিত বক্ষে এসে দাঁড়াতেন ঘরের বাইরে। দেখতেন মা আলুলায়িতকেশে দাঁড়িয়ে আছেন, তাকিয়ে আছেন গঙ্গার দিকে। এইরকম দর্শন যখন নিয়মিত হতে থাকল, তখন গদাধর আর নিয়ম বাঁধা পুজোপদ্ধতিতে কিছুতেই আটকে থাকতে পারলেন না। পুজোর সময় দেখতেন, অন্ন নিবেদনের আগেই মা ভক্ষণ করা শুরু করেছেন। গদাধর সস্নেহে সেই অন্ন মায়ের মুখে তুলে দিতেন। কখনও আবার আগে নিজের মুখে ঠেকিয়ে তবে মাকে দিতেন। বলতেন, ‘মা আমি খেয়েছি, এবার তুই খা’। মায়ের চিবুক ধরে গল্প করতেন, হাসতেন, পরিহাস করতেন, কখনও আবার দিব্যানন্দে নেচে উঠতেন। মাকে শয়ান দিয়ে বলতেন, ‘আচ্ছা মা তুই আমাকে শুতে বলছিস? আচ্ছা শুচ্ছি। বলে মায়ের পাশেই শুয়ে পড়তেন।’
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১৮): কেন টোলের পড়াশোনা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন গদাধর?
এই আচরণের সহজ কোনও ব্যাখ্যা হয় না। আর পাঁচজনের কাছে তা অস্বাভাবিক মনে হতে থাকে। কিন্তু এমন দিব্যভাব যাঁর ভিতর জেগেছে, তাঁর অন্তঃকরণের নাগাল পাওয়া তো বাকি কারোর পক্ষে সম্ভবই নয়। এই অবস্থায় যাঁরা পৌঁছান তাঁরা নিয়মের গণ্ডি পার হয়ে চলে যান। ঠাকুরের ক্ষেত্রে তাই-ই ঘটেছিল। ঠাকুরের এহেন আচরণের মর্মোদ্ধার করতে পারেননি কালিবাড়ির সাধারণ কর্মচারীরা। তাঁরা পূজারীর এহেন ব্যবহারে রেগে আগুন হয়ে উঠলেন। হয়তো তাঁদের সমবেত আক্রমণের মুখেই পড়তে হত ঠাকুরকে। কিন্তু সেদিন তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন স্বয়ং রানিমা আর তাঁর জামাতা মথুরবাবু। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, এই মানুষটি অন্যরকম। আর পাঁচজনের জন্য যে নিয়ম নির্দিষ্ট তা দিয়ে এই মানুষটার বিচার করা উচিত নয়। রানিমা বুঝেছিলেন, ঠাকুরের এই যে ব্যবহার তা যেন স্বচ্ছায় নয়। তিনিও বুঝতে পেরেছিলেন, মা কালীই যেন তরুণ এই পূজারীটিকে দিয়ে সমস্ত কাজ করিয়ে নিচ্ছেন।