জ্বর থেকে পেটের ব্যামো। সমস্ত ধরনের রোগব্যাধির ক্ষেত্রে আজ ভরসা বলতে প্রথমেই মনে পড়ে অ্যান্টিবায়োটিকের কথা। উনিশ শতকের মাঝামাঝি এই একটা আবিষ্কার চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছিল। স্কটিশ বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ফ্লেমিং আবিষ্কার করে ফেললেন ব্যাকটিরিয়া ঘাতক একটি ওষুধ, যার নাম পেনিসিলিন। সম্ভবত বিশ্বের প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক এটিই। তবে খুব সুপরিকল্পিত ভাবে আবিষ্কার হয়নি এই ওষুধটির। বরং এর পিছনে রয়েছে একটি দুর্ঘটনার গল্প। কী হয়েছিল সেদিন? শুনে নিন।
আজকে বলে নয়। জীবাণুর সঙ্গে মানুষের ইঁদুর-বেড়াল খেলাটা চলছে সেই কবে থেকেই। তবে ১৯২৮-এর আগে খেলাটা ছিল অসম। সেই পরিস্থিতিটা অনেকখানি বদলে দিয়েছিল একটি আবিষ্কার। ওষুধের দুনিয়ায় খুলে গেল একটা দরজা। স্কটিশ বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ফ্লেমিং আবিষ্কার করে ফেললেন পৃথিবীর প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিন। তার জন্য পরবর্তীকালে নোবেল পুরষ্কারও জিতে নেন তিনি।
তবে খুব ভাবনাচিন্তা করে গুছিয়ে বসে হয়নি এই আবিষ্কার। বরং হঠাৎই একদিন কাকতালীয় ভাবে খুলে গিয়েছিল বেশ কতগুলো দরজা। বলতে পারেন, এর পিছনে লুকিয়ে রয়েছে একটি দুর্ঘটনা। অবাক করা হলেও ব্যাপারটা কিন্তু সত্যি। দুর্ঘটনাবশতই একদিন আবিষ্কার হয়ে গিয়েছিল পেনিসিলিন নামক এই অ্যান্টিবায়োটিক।
আলেকজান্ডার ফ্লেমিং নিজেই তাঁর একটি লেখায় জানিয়েছিলেন সে কথা। জানিয়েছিলেন, ১৯২৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সকালে যখন তাঁর ঘুম ভাঙে, তখনও তিনি জানতেন না যে এদিনই একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার করে ফেলতে যাচ্ছেন তিনি। আসলে কী ঘটেছিল সেদিন। সেই গল্পেই আসা যাক।
আরও শুনুন: সাক্ষী হিরোশিমা ও নাগাসাকি বিস্ফোরণের, বেঁচেও ফিরেছিলেন সশরীরে, চিনে নিন সেই ব্যক্তিকে
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ করে ততদিনে ইংল্যান্ডে ফিরে এসেছেন ফ্লেমিং। এর আগে সেনা চিকিৎসক হিসেবে কাজ করতেন তিনি। অধ্যাপনার কাজে যোগ দিলেন ইংল্যান্ডে এসে সেন্ট মেরিজ কলেজে। এতদিনে ব্যাক্টিরিয়োলজি নিয়ে পুরোপুরি গবেষণার সুযোগ পেলেন ফ্লেমিং।
বেশ কিছুদিন ধরেই তার মাথায় ঘুরছিল একটি বিষয়। তাঁর মনে হচ্ছিল, মানবদেহের নিশ্চয়ই নিজস্ব কোনও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে, যা বাইরের রোগজীবাণুর সঙ্গে লড়তে সাহায্য করে। তবে প্রত্যক্ষ প্রমাণ তেমন মেলেনি। এর মধ্যে স্ট্যাফাইলোকক্কাস নামে একটি ব্যাকটিরিয়া নিয়ে কাজ করছিলেন ফ্লেমিং। এমনিতেই ভুলো মন তাঁর। কাজ শেষ করে ছুটি কাটাতে চলে গেলেন ফ্লেমিং। কিন্তু গবেষণাগারের পেট্রিডিশটি ধোয়ার কথা ভুলে গিয়েছিলেন বেমালুম। গবেষণাগারে এক ধরনের গোলাকার পাত্র ব্য়বহার করা হয়, তাকেই বলে পেট্রিডিশ। গ্রীষ্মের ছুটি কাটিয়ে এসে তিনি পেট্রিডিশটি ভাল করে খেয়াল করেন। দেখেন, পেট্রিডিশে এমন কিছু একটা জন্মাচ্ছে, যার জন্য স্বাভাবিক ভাবে বাড়তে পাচ্ছে না ওই ব্যাকটিরিয়া। ব্যাপারটা নাড়িয়ে দেয় বিজ্ঞানীকে। শুরু হয় গবেষণা।
পরীক্ষানিরীক্ষার পরে ফ্লেমিং জানতে পারেন, পেনিসিলিয়াম নোটেটাম নামে এক ধরনের ছত্রাকই ওই ব্যাকটিরিয়ার বৃদ্ধি আটকে দিচ্ছে। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে এই পেনিসিলিয়াম ছত্রাক পরীক্ষা করে ফ্লেমিং দেখেন, এই ছত্রাক শুধু ব্যাকটিরিয়ার স্বাভাবিক বৃদ্ধিকেই বাধা দেয় না, বরং সংক্রামক বহু রোগ প্রতিরোধেও সাহায্য করতে পারে। আসলে পেনিসিলিন ছত্রাকটি পেনিসিলিন নামক এক ধরনের বিশেষ রাসায়নিক ক্ষরণ করে, যা ব্যাকটিরিয়াকে প্রতিহত করতে পারে। নিউমোনিয়া, ডিরথেরিয়া, মেনিনজাইটিস এমন ভয়ঙ্কর কিছু জীবাণু আটকাতেও সক্ষম এই অ্যান্টিবায়োটিক। এমনকী গনোরিয়ার মতো যৌনরোগের ক্ষেত্রেও কার্যকরী এই পেনিসিলিন। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই আবিষ্কারকে অনেকেই বলে থাকেন ‘মোস্ট ফরচুনেট মিসটেক’।
আরও শুনুন: নকল ট্রেন, নকল রেললাইন! তৈরি হয়েছিল নকল প্যারিস, কেন জানেন?
১৯২৯ সালের মাঝামাঝি একটি ব্রিটিশ জার্নালে ফ্লেমিংয়ের এই গবেষণা প্রকাশ পায়। তবে বিজ্ঞানীমহলে সে সময় তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি এই গবেষণা। তবে হাল ছাড়েননি ফ্লেমিং। ১৯২৯ থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত টানা গবেষণা চালিয়া যান তিনি। তবে ছত্রাক থেকে কিছুতেই যেন আলাদা করতে পারছিলেন না ওই রাসায়নিকটিকে। ক্রমশ হতাশা গ্রাস করছিল ফ্লেমিংকে। ঠিক সে সময় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বিজ্ঞানী হাওয়ার্ড ফ্লোরিও এবং আর্নেস্ট চেইনের সঙ্গে দেখা হয় ফ্লেমিংয়ের। তাদের সঙ্গে মিলে শুরু হয় কাজ। মানুষের শরীরের উপযোগী অ্যান্টিবায়োটিক তৈরির কাজে লেগে পড়েন তিন বিজ্ঞানী। ইঁদুর-সহ বেশ কয়েকটি প্রাণীর উপরে শুরু হয় প্রি-ক্লিনিক্যাল টেস্টিং।
বাকি অংশ শুনে নিন।