কথায় বলে রাখে হরি মারে কে! এই ব্যক্তির ক্ষেত্রে বোধহয় অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিল কথাটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পারমাণবিক বোমার আঘাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল জাপানের দুটি শহর। প্রাণ হারিয়েছিলেন কয়েক লক্ষ মানুষ। হিরোশিমা আর নাগাসাকি, দুটি শহরের বিস্ফোরণই তিনি দেখেছিলেন চোখের সামনে থেকে। তবে কোনো এক দৈববলে বেঁচে গিয়েছেন দু-বারই। মৃত্যু এসেছিল স্বাভাবিক নিয়মে, প্রায় ৬০ বছর পরে! কেমন ভাবে কেটেছে বিস্ফোরণ পরবর্তী জীবনটা? আসুন, শুনে নিই সেই ব্যক্তির গল্প।
সেটা ১৯৪৫ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে দেশ জুড়ে। জাপানকে কোণঠাসা করতে পারমাণবিক হামলার ছক কষল আমেরিকা। ৬ অগস্ট যুদ্ধবিমান থেকে ফেলা হল পৃথিবীর প্রথম পারমানবিক বোমা- লিটল বয়। এক লহমায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল একটা গোটা শহর। প্রাণ গিয়েছিল প্রায় ২ লক্ষ মানুষের।
তিনদিনের মাথায় ফের বোমা পড়ল জাপানের আরও একটি শহরে। তখন গভীর রাত। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছাই হয়ে গেল নাগাসাকি। আগেরটির চেয়ে আরও শক্তিশালী ছিল এই পারমানবিক বোমাটি। তার নাম দেওয়া হয়েছিল ফ্যাট ম্যান। আশি হাজার মানুষ শেষ হয়ে গেল কয়েক মুহূর্তে।
এই কালো অধ্যায়ের কথা ভুলতে চেয়েও পারেনি ইতিহাস। যেমন পারেননি সুতোমু ইয়ামাগুচি। কী করেই বা ভুলতেন। দুটি বিস্ফোরণই যে ঘটেছিল তাঁর চোখের সামনে। ফেটে গিয়েছিল কানের পর্দা। বেশ কয়েকদিন চোখে দেখতে পেতেন না। তবে কোনও এক দৈব বলে বেঁচে গিয়েছিলেন প্রাণে।
আরও শুনুন: নকল ট্রেন, নকল রেললাইন! তৈরি হয়েছিল নকল প্যারিস, কেন জানেন?
মিৎসুবিশি সংস্থায় মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন ইয়ামাগুচি। নাগাসাকিতেই ছিল তাঁর অফিস। তবে কাজের জন্য সে সময় হিরোশিমায় গিয়েছিলেন বছর উনত্রিশের ইয়ামাগুচি। আকাশে টহল দিচ্ছে যুদ্ধবিমান। প্যারাশ্যুটে করে কী একটা যেন নেমে আসছে শহরের বুকে। দেখতে পেয়েছিলেন ইয়ামাগুচি। তার পরেই ভয়ঙ্কর আলো আর শব্দ। আর কিছু মনে নেই।
হিরোশিমায় বোমা ফেলল আমেরিকা। এক লহমায় গোটা শহরটা শ্মশানে পরিণত হয়েছিল। শরীরের একটা অংশ ঝলসে গিয়েছিল তাঁর। তবে সে যাত্রায় প্রাণে বাঁচেন ইয়ামাগুচি।
তড়িঘড়ি তাঁকে নাগাসাকিতে ফেরানোর বন্দোবস্ত করা হল। ৮ অগস্ট নিজের শহরে ফিরলেন ইয়ামাগুচি। তখন কে-ই বা জানত, দ্বিতীয় বোমাটি পড়তে চলেছে এই শহরেই। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল তাঁকে। তবে বিশ্রাম পেলেন না। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ফের কাজে যোগ দিতে হল ইয়ামাগুচিকে।
৯ অগস্ট মধ্যরাতে পারমাণবিক বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল নাগাসাকি। এই বোমাটির তীব্রতা ছিল আরও কয়েকগুণ। তবে এ বারেও বেঁচে গেলেন ইয়ামাগুচি। সারা গায়ে ব্যান্ডেজ থাকায় তেমন চোট পেলেন না। তবে এক সপ্তাহ পর্যন্ত টানা জ্বর ছিল তাঁর। সঙ্গে বমি।
আরও শুনুন: শত্রুদের চোখে ধুলো দিতে লুকিয়ে ফেলা হয়েছিল আস্ত তাজমহল, কীভাবে জানেন?
সে বছরই শেষ হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। অনেকেই সে সময় দাবি করেছিলেন, এই বিস্ফোরণের জেরেই ভয় পেয়ে তড়িঘড়ি আত্মসমর্পণ করেছিল জাপান। যার ফলে শেষ হয়েছিল ভয়ঙ্কর এই যুদ্ধ। তবে কোনও কিছু দিয়েই এই ভয়ঙ্কর হিংসার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না বোধহয়। শুধু যে সেদিনই কয়েক লক্ষ মানুষ শেষ হয়ে গিয়েছিলেন, তা তো নয়। পরবর্তী বহু প্রজন্মের শরীরে থেকে গিয়েছিল তার প্রভাব। পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার ফলে ওই দুটি শহর ও আশপাশের এলাকায় বিকলাঙ্গ শিশু জন্মায় আজও। আর তার জন্য দায়ী ওই দুই বিস্ফোরণ।
২০০৫ সালে ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মারা যান ইয়ামাগুচির ছেলে। তার পরেই পারমানবিক হামলা নিয়ে মুখ খোলার সিদ্ধান্ত নেন ইয়ামাগুচি। ২০০৯ সালে খোলাখুলি ভাবে এ নিয়ে কথা বলেন তিনি। পারমানবিক বিস্ফোরণের হাত থেকে হয়তো প্রাণে বেঁচে ফিরেছিলেন অনেকেই। তবে হিরোশিমা ও নাগাসাকি- দুই জায়গারই পারমাণবিক হামলার সাক্ষী ছিলেন, এবং প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম বোধহয় ইয়ামাগুচিই। পরবর্তীকালে জাপান সরকারের তরফেও মিলেছিল সেই স্বীকৃতি। ২০১০ সালে ৯৩ বছর বয়সে মারা যান ইয়ামাগুচি। তাঁর জীবনের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল একটি তথ্য়চিত্র। ‘টোয়াইস বম্বড: দ্য লেগাসি অব ইয়ামাগুচি সুতোমু’ নামে সেই তথ্যচিত্রটি মুক্তি পায় ২০১১ সালে। তবে দু-দুবার পারমাণবিক বোমার ফাঁড়া কাটিয়ে কীভাবে যে বেঁচে ফিরেছিলেন এই ব্যক্তি, সেই আশ্চর্য গল্প কিন্তু আজও ভাবায় দুনিয়াকে।