লতা মঙ্গেশকর জানতেন, তিনি এমন একটি ভারতবর্ষের প্রতিনিধিত্ব করছেন, যে ভারতবর্ষের মননে আছে বহুযুগের দার্শনিক উপলব্ধি। সঙ্গীত তো এক অন্তহীন সাধনা। সেই সাধনার স্রোতের সামনে বসে তিনি বোধহয় সকলকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, সুরের থেকে পবিত্র আর কিছু হয় না। সেই সুর মানুষকে খোঁজ দেয় এক অপার শান্তির, এক অনন্য দেশের। যে দেশের আলাদা রং নেই, সে দেশ শান্তির মতোই শুভ্র। সাধকের মতোই তিনি আজীবন সঙ্গী করেছিলেন শুভ্রতাকে।
তিনি সুরের সরস্বতী। দেবী সারদার মতোই শুভ্রবসনা। কালের গণ্ডি পেরিয়ে তাঁর কণ্ঠই তো হয়ে উঠেছে আধুনিক ভারতবর্ষের কণ্ঠস্বর। এই দেশ তাকে কখনও ভালবেসেছে দিদির মতো, কখনও পূজা করেছে দেবীজ্ঞানে। সেই দেশকে তাই তিনি নিজেও মনে করেছেন স্বর্গাদপী গরিয়সী। শুধু এক জন্মে নয়, যদি জন্মান্তর বলে কিছু থেকে তবে কেবলমাত্র ভারতবর্ষের মাটিতেই পুনর্জন্মের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন কিংবদন্তি লতা মঙ্গেশকর।
আরও শুনুন – সুরলোকে সুরসম্রাজ্ঞী, অনন্তে পাড়ি দিলেন লতা মঙ্গেশকর
সুরের তো কোনও আলাদা দেশ হয় না। সাত সুরের আছে একটাই পৃথিবী। সেই পৃথিবীর অলৌকিক বাসিন্দা যাঁরা, তাঁরাই পারেন সবরকম বিভাজনের কাঁটাতার মুছে দিতে। রাষ্ট্র, রাজ্য, নেতা, মতাদর্শ, রাজনীতি – যে যার মতো চলে আলাদা আলাদা পথে। আর কী এক ইন্দ্রজালে সেই সব পথই এসে মিলে যায় সুরের দরজায়। নতজানু হয় সাধকের সামনে। লতা মঙ্গেশকর সেরকমই এক অভিজাত ভারতবর্ষের স্মারক, যেখানে সমস্ত বৈচিত্র নিয়েই ফুটে ওঠে একতার গরিমা। তাঁর পরনের সাদা শাড়ি শুধু তো তাঁর পোশাক-বৈশিষ্ট্যকেই চিহ্নিত করে না, বরং তুলে ধরে এক অন্য পৃথিবীর আদর্শকে। যে পৃথিবী ঘৃণাহীন, শুভ্র, পবিত্র, শান্তির। যেখানে নেই বিভাজন, বরং সব রং এসে যেখানে স্তব্ধ হয়। ফিরে যায় মানবতার আলো গায়ে মেখে।
আরও শুনুন – SPECIAL PODCAST: উড়ো চিঠির হাতছানি আর স্মৃতির কোলাজে ডুব, বাঙালির বাণীবন্দনা
কেন লতাজি সাদা রঙের শাড়ি পরতেন, এ নিয়ে বহুবার বহুজন কৌতূহলী হয়েছেন। হিরেরও ঝোঁক ছিল কিংবদন্তির। সেই ১৯৪৭ সালে, যখন প্রথম রোজগার করছেন, তখন মায়ের জন্য কিনেছিলেন কিছু সোনার গয়না। আর নিজের জন্য কিনেছলেন হিরের একখানা আংটি। শোনা যায়, সে সময় খরচ হয়েছিল ৭০০ টাকা। তারপর থেকে এতগুলো বছর যখনই তিনি সামনে এসেছেন- সে স্টেজে হোক বা টেলিভিশনের পর্দায় – তাঁকে দেখা গিয়েছে শ্বেতশুভ্র শাড়িতেই। মাঝে একবার শাড়ি নিয়ে একটু পরিক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন বটে, তবে তা অল্প সময়ের জন্যেই। তিনি আবার ফিরে যান তাঁর সিগনেচার স্টাইলেই। আজ ফিরে দেখলে মনে হয়, এ শুধু তাঁর পোশাকের সিগনেচার নয়। বা পারফরমেন্সের জন্য নিজের ব্যক্তিত্ব তুলে ধরার সচেতন প্রয়াস মাত্র নয়। এ যেন তার থেকেও বেশি কিছু। লতা মঙ্গেশকর জানতেন, তিনি এমন একটি ভারতবর্ষের প্রতিনিধিত্ব করছেন, যে ভারতবর্ষের মননে আছে বহুযুগের দার্শনিক উপলব্ধি। সঙ্গীত তো এক অন্তহীন সাধনা। সেই সাধনার স্রোতের সামনে বসে তিনি বোধহয় সকলকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, সুরের থেকে পবিত্র আর কিছু হয় না। সেই সুর মানুষকে খোঁজ দেয় এক অপার শান্তির, এক অনন্য দেশের। যে দেশের আলাদা রং নেই, সে দেশ শান্তির মতোই শুভ্র। সাধকের মতোই তিনি আজীবন সঙ্গী করেছিলেন শুভ্রতাকে।
আরও শুনুন – বাংলা মানে শুধু মিষ্টি দই-রসগোল্লা নয়, বাংলাকে চেনা যায় আত্মসম্মানের গরিমাতেই
বিদ্বেষহীন এক পৃথিবীর খোঁজ আজীবন ছিল তাঁর। দীর্ঘ সঙ্গীতজীবনে তাঁর গান ব্যবহৃত হয়েছে নানা ভাবে। বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক পালাবদল তাঁকে এবং তাঁর সংগীতকে গ্রহণ করেছে ভিন্ন প্রেক্ষিতে। তা নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনার জায়গা যে তৈরি হয়নি তা নয়। কিন্তু সুরের ঈশ্বরী তিনি। এই মালিন্যের ধূলি তাঁর অন্তরের শুভ্রতাকে স্পর্শ করেননি। তিনি ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতোই মাথায় ঠেকিয়েছিলেন মানুষের ভালবাসাকে। জীবনে বস্তুগত প্রাপ্তির ভাঁড়ার তো তাঁর কম নয়। তার ভিতর তাঁর জীবনের সেরা পাওনা কী? একবার সাক্ষাৎকারে এর উত্তর দিয়ে লতাজি বলেছিলেন, দেশের মানুষ আমায় যে এত ভালোবাসেন তার থেকে বড় পাওনা আর কী হতে পারে! এই দেশটাকে তিনি ভালবেসেছিলেন ঐতিহ্যের অনুসারী হয়ে। বলেছিলেন, এই দেশে রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের মতো মানুষ জন্ম নিয়েছেন। আরও কত চিন্তক তাঁদের ভাবনায় সমৃদ্ধ করেছেন এই দেশকে। এমন একটা দেশের মানুষ হয়ে তিনি যে ধন্য, তা স্বীকার করেছেন বারবার। শুধু তাই-ই নয়। সাক্ষাৎকারে অকপট জানিয়েছিলেন, যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকে তবে এই ভারতের মাটিতেই তিনি আবার জন্মাতে চান। আক্ষেপ করে বলেছিলেন, কেন মানুষে মানুষে এত ঘৃণা বেড়ে যাচ্ছে! এত ভাগাভাগি ছেড়ে মানুষ কেন মানুষ হয়েই থাকতে পারছে না! প্রার্থনা করেছিলেন ঘৃণার পৃথিবী প্রত্যাখ্যান করে ভালবাসার পৃথিবীর বাসিন্দা যেন হতে পারেন সকলে। মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন সেই চিরন্তন কথা- সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই।
আরও শুনুন – সরস্বতী পুজো করার দাবিতে আন্দোলন কলেজের ছাত্রদের, মতান্তরে জড়ালেন রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্র
লতা মঙ্গেশকর একজন কিংবদন্তি শিল্পী। এ পৃথিবী তাঁকে একবারই পায়। তবে এই শিল্পী পরিচয়ের বাইরে, সবার উপরে তিনি নিজেই যেন ছিলেন একটা দেশ। যাঁর সামনে এসে বাকি সব বিভাজন মিথ্যে হয়ে যায়। জেগে থাকে মানুষের একটাই পরিচয় যে, সে মানুষ। তাঁর আজীবনের সঙ্গীতসাধনা দিয়ে এই মানুষের দেশটিকেই তিনি নির্মাণ করেছিলেন অতি সচেতনে। ধনি, গরিব, ধর্ম, মত, রাজ্য সব তুচ্ছ হয়ে যায় লতা মঙ্গেশকরের সামনে। বিভিন্নতার ভিতর এই যে একতা – এই-ই তো প্রকৃত ভারতবর্ষ। এতদিন ধরে ভারতবর্ষের আত্মাটিকেই যেন তিনি চিনিয়ে দিতে চেয়েছেন, আমাদের সকলকে। আমরা যদি তা লালন করতে পারি, যদি বিদ্বেষ মুছে সেই ভালবাসার দেশটিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি, তবেই হয়তো প্রয়াত শিল্পীর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন সার্থক হয়ে উঠবে সর্বার্থেই।