যিনি সর্বভূতে সমান ও সমভাবে অবস্থিত ঈশরকে দর্শন করেন, তিনি আত্মা দ্বারা আত্মাকে হনন করেন না। অর্থাৎ আত্মার স্বরূপ উপলব্ধি করে আত্মাকে তিনি উন্নত বা উদ্ধার করার চেষ্টা করেন। এই দুর্লভ মানুষ জন্ম পেয়েও যিনি আত্মার উদ্ধারের চেষ্টা না করেন, জ্ঞানীরা বলেন, তিনিই আত্মঘাতী।
সংসারের থেকেও ঈশ্বরের সাধনা সম্ভব। সংসারী হয়েও একজন ভক্ত তাঁর আরাধ্যকে লাভ করতে পারেন। অনেকে বলেন, সংসারবন্ধন ছিন্ন করলেই, তবে ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করা যায়। আবার কেউ কেউ বলেন, সংসারে থেকেই সেই বন্ধন কাটানো সম্ভব, যদি সংসারের স্বরূপটি কেউ সঠিক অনুধাবন করতে পারেন। কী এই সংসারের স্বরূপ? সংসারকে কল্পনা করা হয়েছে একটি বড় অশত্থগাছের মতো। কিন্তু ভারী অদ্ভুত সেই বৃক্ষ। অভুত কারণ, সেই বৃক্ষ ‘ঊর্ধ্বমূলম’ অর্থাৎ যার মূল ঊর্ধ্বে। আর, বৃক্ষটি ‘অধঃশাখম’ – অর্থাৎ যার শাখাগুলো অধোগামী। এই অদ্ভুত বৃক্ষটিকে চিনতে পারলেই আমাদের সংসার চেনা সম্পূর্ণ হবে। অবশ্য এইভাবে দেখতে পারে বা এই দর্শনে পৌঁছাও সহজ কথা নয়। কোনও কোনও ব্যক্তি সেই দর্শনকে আয়ত্ত করতে পারেন।
আরও শুনুন – মা লক্ষ্মীর অভিশাপেই মৃত্যু রাবণের, কেন অভিশপ্ত হয়েছিলেন লঙ্কেশ্বর?
এইরকম যথার্থদর্শী ব্যক্তি কারা? তার ব্যাখ্যা আছে শ্রীগীতায়। বলা হয়, প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগে যে এই সৃষ্টির উৎপত্তি সে কথা তো অনেকেই জানেন। কিন্তু যিনি এই সংযোগের মধ্যে বিয়োগ দর্শন করেন, তিনিই যথার্থদর্শী হয়ে ওঠার প্রথম ধাপে অবস্থান করেন। অর্থাৎ সত্যিকার জিনিসটি তিনিই দর্শন করতে শুরু করেছেন। এখন এই সংযোগের মধ্যে বিয়োগ দর্শন কথাটার অর্থ হল, প্রকৃতি থেকে পুরুষের বা দেহ থেকে আত্মার পার্থক্য দর্শন করা। কিন্তু শুধু এই পার্থক্যটুকু দেখতে পেলেই হবে না। এই পার্থক্য সত্ত্বেও যিনি সেই একই বস্তু সর্বত্র সমভাবে বিদ্যমান – এই অনুভব করতে পারেন, তিনিই মুক্ত। তিনিই প্রকৃত দর্শনে পৌঁছাতে পেরেছেন। এই দর্শন যাঁর হয়, অর্থাৎ যিনি সর্বভূতে সমান ও সমভাবে অবস্থিত ঈশরকে দর্শন করেন, তিনি আত্মা দ্বারা আত্মাকে হনন করেন না। অর্থাৎ আত্মার স্বরূপ উপলব্ধি করে আত্মাকে তিনি উন্নত বা উদ্ধার করার চেষ্টা করেন। এই দুর্লভ মানুষ জন্ম পেয়েও যিনি আত্মার উদ্ধারের চেষ্টা না করেন, জ্ঞানীরা বলেন, তিনিই আত্মঘাতী। অপরদিকে যিনি আত্মোন্নতির চেষ্টা করেন তিনি ক্রমে জ্ঞানী হয়ে ওঠেন। এখন, আত্মা দ্বারা আত্মকে হনন না করার একটি অন্য অর্থও হয়। স্বামী বিবেকানন্দ সেই অর্থটিই স্বীকার করেছিলেন। তাঁর মতে, এই জ্ঞান যাঁরা হয়েছে অর্থাৎ আত্মপর ভেদ যার নেই, তিনি পরহিংসা ও আত্মহিংসাকে আলাদ করে দেখেন না। তিনি জীবের প্রতি হিংসা করেন না।
আরও শুনুন – কেন স্বয়ং নারায়ণ জ্ঞানে পুজো করা হয় শালগ্রাম শিলা?
অর্থাৎ যথার্থদর্শী তিনিই, যিনি জানেন, প্রকৃতিই সমস্ত প্রকার কর্ম করেন, এবং আত্মা অকর্তা। আত্মা অকর্তা এবং নিঃষঙ্গ। প্রকৃতির সান্নিধ্যবশতই তাতে কর্তৃত্ব আরোপিত হয়। এইভাবে যিনি নিজেকে অকর্তা বলে ভাবতে পারেন, তিনিই আসলে কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হন। জগতের নানাত্বের মধ্যে যিনি একমাত্র ব্রহ্মসত্তাকে অনুভব করেন, তিনিই ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হন। আত্মার বন্ধনও নেই, মোক্ষও নেই। আত্মা নিত্য-মুক্ত-শুদ্ধ স্বভাব। সংযোগ, বিয়োগ, বন্ধন, মোক্ষ – এগুলি প্রকৃতিরই ধর্ম। এবং তা আত্মায় আরোপিত হয়। পুরুষ অকর্তা ঠিকই, কিতু পুরুষ প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হয়ে তার গুণসমূহ ভোগ করে। প্রকৃতির এই গুণই পুরুষের সংসারিত্বের কারণ। এই ব্যাখ্যা দেয় শ্রীগীতা।
আরও শুনুন – ধর্মপালনের বিনিময়ে যে ফল চায় সে ধর্মবণিক, কেন বলা হয় এ কথা?
এই ব্যাখ্যা ছুঁয়েই আমরা দেখে নিতে পারি সংসারবৃক্ষের স্বরূপটি। কেন সংসারবৃক্ষের মূল ঊর্ধগামী? কেননা পুরুষোত্তম বা পরমাত্মা থেকেই এই বৃক্ষ উৎপন্ন হয়েছে। তাই একে বলা হয় ব্রহ্মবৃক্ষ। এই বৃক্ষে যেগুলোর শাখার মতো অর্থাৎ মহতত্ত্ব , অহঙ্কার ইত্যাদি ক্রমশ অধোগামী, তাই এই বৃক্ষ অধঃশাখ। আর বেদগুলি হল এই বৃক্ষের পাতা। পাতা যেমন আচ্ছাদনের মতো হয়ে বৃক্ষকে রক্ষা করে, তেমনই বেদও ছায়ার মতো সর্বজীবের রক্ষক এবং আশ্রয়। এই সংসার বৃক্ষকে যিনি জানেন তিনি বেদজ্ঞ। সমূল সংসারবৃক্ষকে জানলে জীব, জগৎ, ব্রহ্ম – এই তিনেরই জ্ঞান হয়। যিনি তা জানেন, তাঁর আর জানবার কিছু অবশিষ্ট থাকে না।