এ যেন সেই জলে শিলা ভাসার মতোই আশ্চর্য ব্যাপার! পাহাড়ি ঢালে গাড়ি যে নিচের দিকে গড়িয়ে যাবে, তা-ই তো স্বাভাবিক। কিন্তু এমন একটা পাহাড় আছে, যার ঢালে গাড়ির চাকা নিচের বদলে গড়াতে শুরু করে উপরের দিকে। হ্যাঁ, নিউটন সাহেবকে হতবুদ্ধি করে অভিকর্ষের নিয়ম যেন ভেঙেই প্রকৃতিতে ঘটতে থাকে এই অদ্ভুত ঘটনা! কিন্তু সত্যিই কি ভাঙে অভিকর্ষের নিয়ম! যদি না ভাঙে তবে কী এই পাহাড়ের রহস্য! আসুন শুনে নিই।
দৃশ্যটা যে কোনও রহস্যগল্পের ঘটনার থেকে কম রোমাঞ্চকর কিছু নয়! পাহাড়ি ঢালে দাঁড়িয়ে আছে কোনও গাড়ি। ইঞ্জিন বন্ধ। কিন্তু গাড়ি আপনাপানিই গড়াচ্ছে! তা-ও ঢাল বরাবর অর্থাৎ নিচের দিকে নয়। উঠছে উপরের দিকে। কেউ বলেন আজগুবি! কেউবা ভৌতিক। সে তর্কে যাচ্ছি না, তবে ঘটনাটি তো সত্যিই আর কোনও গল্প থেকে নেওয়া নয়। বাস্তবেই তা হয়। প্রকৃতিতে অনেক সময়ই এমন ঘটনা ঘটতে থাকে, যার কোনও সহজ ব্যাখ্যা মেলে না। এ-ও সেরকমই একটি বেনিয়মের ঘটনা।
এই দৃশ্যের দেখা মিলবে লে শহর থেকে একটু দূরে। এমনিতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর রোমাঞ্চকর অভিযানের জন্য তো লেহ্-লাদাখের জুড়ি মেলা ভার। আশ্চর্য সব অভিজ্ঞতা জমা হতে থাকে অভিযাত্রীর ঝুলিতে। এই ‘লেহ্’ শহর থেকেই ৩০ কিলোমিটার দূরে আছে একটি পাহাড়। অনেকে বলে থাকেন, এ নাকি হল চুম্বক-পাহাড়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৪ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত এই জায়গাটায় প্রকৃতির অদ্ভুত সব খেয়াল লক্ষ করা যায়। লেহ্-কার্গিল হাইওয়ের উপরে এই বিশেষ জায়গাটি জুড়ে নাকি অভিকর্ষ বিশেষ কাজ করে না। রাস্তা নিজেই অদ্ভুত ভাবে টানতে থাকে গাড়িগুলিকে। ইঞ্জিন বন্ধ থাকা সত্ত্বেও নাকি ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার বেগে এগোতে থাকে গাড়ি। ঢাল বেয়ে যে গড়িয়ে যাচ্ছে, তেমনটা কিন্তু নয়। বরং উৎরাই থেকে চড়াইয়ের দিকে গাড়ি এগোয় এমনিই।
আরও শুনুন: সুখের খোঁজে গোটা একটা মিউজিয়াম! বিশ্বের কোথায় এমন সংগ্রহশালা আছে জানেন?
তবে না, এ নেহাত ভৌতিক ঘটনা নয়। যাঁরা এর রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করেছেন, তাঁরা বলছেন, এই এলাকাটুকুতে রয়েছে চৌম্বকীয় ক্ষেত্র, যার তীব্রতা বেশ ভালই। সেই চৌম্বক ক্ষেত্রই আকর্ষণ করে গাড়িগুলিকে। আর তার ফলেই বন্ধগাড়ি অভিকর্ষ না মেনে উঠে যায় উপরের দিকে। আর একটি মতও অবশ্য আছে। কেউ কেউ বলে থাকেন, এ আসলে সবটাই বিভ্রম বা অপটিক্যাল ইলিউশন। আবার লাদাখের স্থানীয় মানুষকে জিজ্ঞেস করলে তাঁরা শোনাবেন একেবারে অন্যরকম একটি গল্প। তাঁদের বিশ্বাস, ওই পথেই একদিন স্বর্গের সিঁড়ি ছিল। যোগ্যতমকে আপনাআপনিই সেই পথে টেনে নেয় পাহাড়। পাপীরা সেই পথ খুঁজে পান না কোনওদিনই।
এই রহস্যপাহাড়ের রহস্য আজও পুরোপুরি দূর হয়নি। মনে করা হয় যে, সত্যি সত্যিই ওখানে কোনও শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। সেই কারণে ওই রুটটি এড়িয়ে চলে ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সও।
আরও শুনুন: কাঁটাচামচ ব্যবহার করলে অভিশাপ দেবেন দেবতারা, কেন ছিল এমন বিশ্বাস?
পাহাড়ের এই রহস্য নিয়ে নানা মত নিজের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এই প্রাকৃতিক আশ্চর্য দেখতে সেখানে ছুটে যান অসংখ্য পর্যটক। ওই বিশেষ জায়গাটি চিহ্নিত করে সেখানে একটি বোর্ডও বসিয়ে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। ঠিক কোন জায়গা থেকে সবচেয়ে ভাল করে বোঝা যাবে ব্যপারটি, তাও রং দিয়ে চিহ্নিত করা আছে। আর্মেনিয়ার আরাগাট পর্বতমালার কাছেও নাকি এমনই একটি জায়গা রয়েছে বলে জানা যায়, যেখানে অভিকর্ষ ঠিকঠাক কাজ করে না। তবে আসল কারণটি যে ঠিক কী, তার ব্যাখ্যা দিতে পারেননি আজ অবধি কেউই। আসলে সমস্ত ব্যাখ্যা, গবেষণার ঊর্ধ্বেও প্রকৃতিই যে সর্বশক্তিমান, সে কথাই বোধহয় আরও একবার মনে করিয়ে দেয় লাদাখের এই রহস্য-পাহাড়।