এই সেদিনও ভাইরাল শব্দটা অসুখবিসুখের সঙ্গেই জড়িয়ে ছিল। গত এক কি দেড় দশকে তার মানেটা অনেকখানিই বদলে গিয়েছে। ভাইরাল এখন যত না চিকিৎসা জগতের সঙ্গে জড়িত, তার থেকেও বেশি যেন নেটদুনিয়ার বিষয়। যে কোনও কন্টেন্ট – সে ছবি হোক বা ভিডিও কিংবা অডিও ক্লিপ – রাতারাতি ভাইরাল হয়ে ওঠে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এই যে ভাইরাল হওয়া বা ভাইরাল করার প্রবণতা – সে কি একরকম সময়ের অসুখ? আমাদের স্বাভাবিক জীবনে এর প্রভাবই বা কতখানি? এ বিষয়ে আলোচনা চলছে বিশ্বজুড়েই। মতামত দিচ্ছেন বিশেজ্ঞরা। আসুন শুনে নেওয়া যাক।
অমুখ ভিডিও ভাইরাল। তমুখ অডিও ভাইরাল। এসব কথা এখন আমরা আকছারই শুনি। ব্যাপারটা আমাদের কাছে বেশ গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। যদি একটু খতিয়ে দেখা যায়, তাহলে এর একটা অন্য দিকও চোখে পড়বে। কোনও একটা কন্টেন্ট, বিষয়ের জেরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে সেটা স্বাভাবিক ঘটনা। তবে যদি ঝোঁকটাই এরকম হয়ে যায় যে, বিষয়টিকে ছড়িয়ে দিতে হবে বা ভাইরাল করে তুলতে হবে, তাহলে সেটি একটি বিশেষ প্রবণতা হিসেবেই চিহ্নিত হবে। এই প্রবণতাটি বর্তমান সময়ের একটি লক্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কোনও জিনিসকে ভাইরাল করার নেশা আমাদের পেয়ে বসেছে। বিশেজ্ঞরা বলছেন, এই যে ভাইরাল হওয়া বা ভাইরাল করা – তার মধ্যে থেকে যায় একরকম অপ্রত্যাশিত আনন্দ পাবার প্রত্যাশা। তা আবার একদিক থেকে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনকেও প্রভাবিত করছে। বলা যায়, দ্রুত বদলে দিচ্ছে জীবনধারাকে।
আরও শুনুন – বাংলা মানে শুধু মিষ্টি দই-রসগোল্লা নয়, বাংলাকে চেনা যায় আত্মসম্মানের গরিমাতেই
এখন আনন্দ খুঁজে পাওয়া তো দোষের নয়। তাহলে এই ভাইরাল প্রবণতা নিয়ে কেন ভাবিত বিশেষজ্ঞরা? ব্যাপারটা একটু খোলসা করেই বলা যাক। ধরা যাক, কেউ একজন জন্মদিনের একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করছেন। অনেকদিন থেকেই পরিকল্পনা চলছে। সেইমতো কেনাকাটা হয়েছে, বন্ধুবান্ধবদের ডাকা হয়েছে। নির্দিষ্ট দিনে ভালোয় ভালোয় সেই অনুষ্ঠান মিটে গেল। এই পুরো ঘটনা একরকম আনন্দ আমাদের দেয়। কিন্তু এটাই যদি হয় একটা সারপ্রাইজ পার্টি, তবে তার আনন্দের মাত্রাটাই আলাদা! যা অপ্রত্যাশিত, হওয়ার কথাই ছিল না, তা আনন্দের পাশাপাশি একরকম উত্তেজনাও দেয়। নেটদুনিয়ায় কন্টেন্ট ভাইরাল হওয়া বা করার ক্ষেত্রে এই উত্তেজনা লুকিয়ে থাকে।
আরও শুনুন – দক্ষিণেশ্বর থেকে এল মায়ের আশীর্বাদ, ব্রিটিশ গোয়েন্দার চোখে ধুলো দিয়ে দেশ ছাড়লেন সুভাষ
নেটদুনিয়ায় যে কোনও কনন্টেন্ট পোস্ট করা মাত্রই, যিনি পোস্ট করেন তাঁর লাইক, শেয়ার, কমেন্টের প্রত্যাশার পারদ চড়তে থাকে। কেননা বর্তমান সময়ে এগুলিই জনপ্রিয়তার সমার্থক বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। এরই একটা বৃহত্তর রূপ হচ্ছে ভাইরাল হওয়া। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রির অধ্যাপক ড. এলিয়াস আবুজেইউদে বলছেন, ভাইরাল হওয়া হল ভারচুয়াল মিডিয়ার নিরিখে জনপ্রিয়তম চিহ্নিত হওয়ার প্রমাণ। এই প্রবণতা আমাদের মস্তিষ্ককে কতখানি প্রভাবিত করে, তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন তিনি। কেননা আমাদের এই আনন্দ-অনুভূতির নেপথ্যে থাকে একরকমের কেমিক্যাল মেসেঞ্জার। রাসায়নিক সেই বার্তাবাহকের নাম ডোপামিন। যখনই নিজের কন্টেন্ট ভাইরাল হয়, তখন আসলে হতে থাকে ‘ডোপামিন রাশ’।
আরও শুনুন – মাথা জুড়ে সার্জারির দাগ, চুল কামানো… একরত্তি মেয়েকে সঙ্গ দিতে মাথা কামালেন বাবাও
আর-এক বিশেষজ্ঞ কোর্টনি ট্রেসি বলছেন, সোশ্যাল মিডিয়ার যে কোনও রকম স্বীকৃতি এই ডোপামিন চলাচলের একটি রাস্তা খুলে দেয়, এবং আমাদের মস্তিষ্ক তা গ্রহণও করে। ফলে এই প্রবণতা যে আমাদের শারীরিক ভাবে প্রভাবিত করে তা নিশ্চিত। ট্রেসি বলছেন, এ বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণার যেমন প্রয়োজন পাশাপাশি আর একটা দিকও খেয়াল রাখতে হবে। এই ভাইরাল হওয়ার আনন্দ আমাদের জীবনধারাকেও বদলে দিচ্ছে। ছোট ছোট আনন্দের মুহূর্তকে মুছে দিচ্ছে। একটি ভাল ছবি দেখা বা গান শোনার যে আনন্দ, যা এতদিন মানুষ পছন্দ করত, তা আমাদের আজ আর খুব একটা বেঁধে রাখতে পারছে না। পরিবর্তে আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্মে আসক্ত হয়ে পড়ছি। খুঁজে নিচ্ছি অন্যরকম আনন্দ ও উত্তেজনার রসদ। এই জন্যেই দেখা যায় কোনও কোনও মানুষ দীর্ঘ সময় ব্যয় করছেন এই ধরনের ভারচুয়াল প্ল্যাটফর্মে, বিশেষত অল্পবয়সিরা। ডোপামিন হল ফিল-গুড কেমিক্যাল। সেই ‘ডোপামিন রাশ’ যখন আমাদের চাহিদা হয়ে উঠছে, তখন বুঝতে হবে জীবনের সাধারণ ফিল-গুড বিষয়গুলোই বদলে যাচ্ছে ভাইরালের নেশায়। বহুসংখ্যক মানুষ চাইছেন যাতে তাঁদের ইগো সন্তুষ্ট হয়। সেইমতো তাঁরা খুঁজে নিচ্ছেন নিজের মতের পক্ষে স্বীকৃতি। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পোস্ট-ট্রুথ সংস্কৃতিও। অর্থাৎ সবকিছুই যেন সুতোয় বাঁধা, আসছে হাত ধরাধরি করেই। আর কান টানলে মাথা আসার মতোই তাই চলে আসছে অবসাদ। ভাইরাল করার লক্ষ্যে যে কন্টেন্ট তৈরি হচ্ছে তা প্রত্যাশিত ফল না দিলে ঘিরে ধরছে হতাশা। সোশ্যাল মিডিয়া সংক্রান্ত এজেন্সির কর্মীরা এর ভুক্তভোগী।
আরও শুনুন – তিনি মেয়র, তিনিই নাগরিক… আশ্চর্য এই শহরের বাসিন্দা মাত্র একজনই
ফলত নেটদুনিয়ার বিষয় হলেও ভাইরাল যে সেই অসুখের সঙ্গেই জড়িত থেকে গেল, তা যেন একরকম আয়রনি। বলা যায়, এ হল সময়ের অসুখ। কেননা, এই প্রবণতা আমাদের অন্তত দুটো বিষয়ে ভাবাচ্ছেই ভাবাচ্ছে। এক, ক্রমাগত ভাইরাল হওয়া বা করার নেশা কি আমাদের যুক্তিপূর্ণ চিন্তাভাবনার ক্ষমতাকেই নষ্ট করে দিচ্ছে? উত্তর খুঁজে পাওয়া জরুরি। পাশাপাশি এও ভাবা জরুরি যে, আমরা যা দেখছি তার উপর কি আদৌ আমাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ আছে! নাকি চোখের সামনে যা হচ্ছে সেগুলোই ক্রমশ নিয়ন্ত্রণ করছে আমাদের? ভাইরালের নেশা ভালো করে পেয়ে বসার আগে, এই প্রশ্নগুলোর কাছে ফেরা আবশ্যক বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।