শ্রীম সেদিন এসেছেন দক্ষিণেশ্বরে। নরেন্দ্রনাথও ছিলেন। পঞ্চবটীতে বসে ছিলেন, হঠাৎ সেখানে ঠাকুর এসে উপস্থিত হলেন। হাতখানা ধরলেন নরেন্দ্রনাথের। মুখে মিটিমিটি হাসি। বললেন, তোর বিদ্যাবুদ্ধি কত আজ বোঝা যাবে। তুই তো আড়াইটা পাস করেছিস। আজ তিনটে পাস করা মাস্টার এসেছে। চল তার সঙ্গে কথা কইবি।
ভবিষ্যতের জন্য নরেন্দ্রনাথকে তৈরি করার কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। সেদিনের যুবক নরেন্দ্রনাথ অবশ্য সে কথা তেমন করে বুঝতেন না। ঠাকুরের এ যেন গোপন লীলা। যিনি রাম, যিনি কৃষ্ণ তিনিই তো এ যুগে এসেছেন রামকৃষ্ণ হয়ে। তবে সেই হাটে হাঁড়ি ভাঙার কাজ তো করবেন অনেক পরে। তার আগে কারোর কাছেই সেভাবে নিজের রূপ প্রকাশ করেননি। নিজেকে যেমন ঠাকুর আড়াল করে রেখেছিলেন, তেমন খানিকটা আড়াল থেকেই শুরু করে দিয়েছিলেন নরেন্দ্রনাথকে গড়েপিটে নেবার কাজ।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১০): কেন নরেন্দ্রনাথকে অবাধ স্বাধীনতা দিতেন ঠাকুর?
সেই কাজের খাতিরেই যেন মাঝেমধ্যে ঠাকুর এক কাণ্ড করতেন। নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে অপর এক ভক্তের তর্ক বাধিয়ে দিতেন। তারপর দূর থেকে দেখতেন সবকিছু। ঠাকুরের ভক্ত শ্রীম অর্থাৎ মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত আসতেন ঠাকুরের দর্শনে। তাঁর ভিতর যে জ্ঞানের যে অভিমান ছিল, তা-ও কাটিয়ে দিয়েছিলেন ঠাকুর। সে আর এক প্রসঙ্গ। এই শ্রীম-ই পরে রচনা করবেন ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’। বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়বে সেই মহাগ্রন্থ। বাংলার মানুষ চিনতে পারবে তাদের প্রাণের ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে। এই শ্রীম সেদিন এসেছেন দক্ষিণেশ্বরে। নরেন্দ্রনাথও ছিলেন। পঞ্চবটীতে বসে ছিলেন, হঠাৎ সেখানে ঠাকুর এসে উপস্থিত হলেন। হাতখানা ধরলেন নরেন্দ্রনাথের। মুখে মিটিমিটি হাসি। বললেন, তোর বিদ্যাবুদ্ধি কত আজ বোঝা যাবে। তুই তো আড়াইটা পাস করেছিস। আজ তিনটে পাস করা মাস্টার এসেছে। চল তার সঙ্গে কথা কইবি।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৯): নরেন্দ্রনাথের জন্য হাসিমুখে লাঞ্ছনাও ভোগ করেছিলেন ঠাকুর
সেই সময় নরেন্দ্রনাথ বিএ পড়তে শুরু করছিলেন। আর মহেন্দ্রনাথ এমএ পাস করে আইন পড়তে শুরু করেছেন। অর্থাৎ ডিগ্রির বিচারে মহেন্দ্রনাথ খানিকটা এগিয়ে। ঠাকুর জোর করে নরেন্দ্রনাথকে তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসিয়ে দিলেন। তা শুরু হল কথাবার্তা। ঠাকুর যেন দূর থেকে বসে দেখে নিচ্ছিলেন, তাঁর নরেন্দ্রনাথের কথা বলবার ক্ষমতা কতখানি, যুক্তির জোর কতটা। যে পরে জগৎকে শিক্ষা দেবে, তার তো এই জোর থাকা চাই। সেদিনের মতো কথাবার্তা শেষ হলে শ্রীম বিদায় নিলেন। তখন ঘোষিত হল ঠাকুরের রায়। বললেন, পাস করলে কী হয়, মাস্টারের মাদীভাব। কথা কইতে পারে না।
আরও শুনুন: শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৮): নরেন্দ্রনাথের মনের দৃঢ়তা পরীক্ষা করে দেখেও নিতেন ঠাকুর
তা মহেন্দ্রনাথ অন্যরকম হলেও, কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায় তো তেমন মানুষ নন। তাঁর তর্কশক্তি প্রবল। তেমনই প্রবল তাঁর ভক্তিভাব। কীর্তন শুনলে বা ভগবৎ প্রসঙ্গে তাঁর দু-চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ত। ঠাকুর নিজে তাঁর এই ভাবের খুব প্রশংসা করতেন। ঠাকুরের কাছে বহু মানুষ যেতেন। নিজেদের প্রশ্ন করতেন। ঠাকুর সকলকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে আর পারতেন না। একদিন মাকে বলেই ফেলেছিলেন, ‘মা, আমি আর এত বকতে পারি না; তুই কেদার, রাম, গিরিশ ও বিজয়কে একটু একটু শক্তি দে, যাতে লোকে তাদের কাছে গিয়ে কিছু শেখবার পরে আমার কাছে আসে এবং দুই-এক কথাতেই চৈতন্যলাভ করে!’ সে অবশ্য অনেক পরের কথা। তবে ভক্ত কেদারকে গোড়া থেকেই স্নেহ করতেন ঠাকুর। সেই কেদারের সঙ্গেও একদিন নরেন্দ্রনাথকে মুখোমুখি বসিয়ে দিলেন। কেদার চোখা চোখা বাক্যবাণে তর্ক করছিলেন। যুক্তির সঙ্গে শ্লেষও ছিল তাঁর কথায়। কিন্তু নরেন্দ্রনাথের যুক্তির ধারের সামনে শেষমেশ তাকে নিরস্ত হতে হল।
আরও শুনুন- শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৭): ঠাকুরকে গুরু হিসাবে মেনে নিতে সম্মত হলেন নরেন্দ্রনাথ
তিনি চলে যেতে ঠাকুর নরেন্দ্রনাথকে ডেকে বললেন, কী রে কেমন দেখলি? ভক্তিভাবে কেদারের চোখে যে জল আসে, সে কথারও উল্লেখ করলেন। কিন্তু এ জিনিস আবার নরেন্দ্রনাথ একেবারেই পছন্দ করতেন না। তিনি তেজস্বী, তাঁর এই ভাব পছন্দ না হওয়াই স্বাভাবিক। তিনি ঠাকুরকে স্পষ্ট কথা বলতে দ্বিধা করলেন না। বললেন, সে আমি কেমন করে জানব? আপনি মানুষ বোঝেন, আপনি বলতে পারেন। নতুবা কান্নাকাটি দেখে ভালমন্দ কিছুই বোঝা যায় না। একদৃষ্টে চেয়ে থাকলে চোখ দিয়ে অমন কত জল পড়ে! আবার শ্রীমতীর বিরহসূচক কীর্তনা শুনে যারা কাঁদে, তাদের অনেকেই নিজ নিজ স্ত্রীর সঙ্গে বিরহের কথা স্মরণ বা আপনাতে ওই অবস্থার আরোপ করিয়া কাঁদে, তাতে সন্দেহ নেই! ওই রূপ অবস্থার সঙ্গে সম্পূর্ণ অপরিচিত আমার ন্যায় ব্যক্তিগণের মাথুর কীর্তন শুনিলেও অন্যের ন্যায় সহজেই কাঁদিবার প্রবৃত্তি কখনই আসিবে না।” একেবারে শাণিত ছুরির মতোই এল নরেন্দ্রনাথের উত্তর। কোনও রাখঢাক নেই। ঠাকুর এ কথা শুনে একটুও রেগে গেলেন না। বরং প্রসন্ন হলেন। বুঝলেন, তাঁর নরেন্দ্রনাথ একেবারে অন্যরকম ভাবেই তৈরি হচ্ছে। যা সত্য তা প্রকাশ করতে তাঁর বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। ঠাকুরের সামনে নির্ভয়ে সে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে। ঠাকুর বুঝলেন, সত্যপ্রাণ নরেন্দ্রনাথের ভাবের ঘরে কোনও চুরি নেই। এই মানুষই তো তিনি চাইছিলেন। এঁকে দিয়েই হতে পারে জগতের কাজ। নরেন্দ্রনাথকে দেখে নিশ্চিন্ত হন ঠাকুর।