ভারতীয় টাকায় কেন থাকবে না নেতাজির ছবি? এ দাবি দেশবাসীর অনেকদিনেরই। তা পূরণ হবে কিনা, সে তো আলাদা কথা। ভবিষ্যতের গর্ভেই তোলা আছে সে উত্তর। তবে, এককালে এমন এক মুদ্রা বা নোট চালু ছিল, যেখানে মুদ্রিত ছিল নেতাজির ছবি। আসুন আমরা সে ব্যাপারে বিশদে শুনে নিই।
নোটের একদিকে নেতাজির ছবি। মাঝে লেখা টাকার অঙ্ক। অন্যদিকে স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতবর্ষের মানচিত্র। আশ্চর্য হলেও, এরকম টাকা বা নোট কিন্তু সত্যিই একসময় প্রচলিত ছিল। যদিও আজকের টাকার ধারণার সঙ্গে তার পার্থক্য অনেকখানিই। দেশকে স্বাধীন করতে নেতাজির যে বিরাট পরিকল্পনা, তারই অঙ্গ হিসাবে এসেছিল এই নোট। এই নোটের মধ্যে ‘স্বতন্ত্র ভারত’ এবং ‘জয় হিন্দ’ কথাদুটি লিখে রেখেছিলেন নেতাজি। দেশের মুক্তি প্রসঙ্গে তাঁর যে দর্শন, তারও সাক্ষ্য যেন বহন করছে এই নোট।
আরও শুনুন- দক্ষিণেশ্বর থেকে এল মায়ের আশীর্বাদ, ব্রিটিশ গোয়েন্দার চোখে ধুলো দিয়ে দেশ ছাড়লেন সুভাষ
নেতাজির লক্ষ্য ছিল পূর্ণ স্বরাজ। বাইরে থেকে সেনাবাহিনি সংগঠিত করে দেশ থেকে ব্রিটিশ শক্তিকে উৎখাত করতেই তিনি দেশ ছেড়েছিলেন। যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, তা পূরণ করার পথে অনেকটা এগিয়েওছিলেন নেতাজি। কেন তা শেষমেশ পুরোপুরি সফল হয়নি, ইতিহাসে তা লেখাজোকা আছে, নানা ব্যাখ্যাও আছে। তবে লক্ষ্যে এগোনোর পথে একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন নেতাজি, যা আমাদের আজও বিস্মিত করে। সেরকমই একটি হল ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা।
আরও শুনুন – জরুরি তলব চিত্তরঞ্জনের, এসেছে বিয়ের প্রস্তাব, মিলবে অনুদানও… কী জবাব সুভাষচন্দ্রের?
১৯৪৪ সালের এপ্রিল মাস। তখনকার রেঙ্গুনে স্থাপিত হয়েছিল আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্ক বা ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স। লক্ষ্য ছিল অর্থ সংগ্রহ। অর্থাৎ, ব্রিটিশ বিরোধী যুদ্ধের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন, তার জোগান বজায় রাখা। নেতাজির দূরদৃষ্টি ছিল তুলনাহীন। দেশের স্বাধীনতার এই যুদ্ধে তিনি শামিল করতে চেয়েছিলেন বহু মানুষকেই। আজাদ হিন্দ বাহিনির কাজকর্ম বজায় রাখার জন্য যে অর্থ দরকার, নেতাজি ঠিক করেছিলেন, একেবারে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার মতো করেই চলতে থাকুক সেই অর্থের লেনদেন। ব্যাঙ্কের সঙ্গে সঙ্গেই এল এই বিশেষ নোট। যেখানে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হত যে, দেশের মুক্তির পর সেই অঙ্কের টাকা দেওয়া হবে। বলা যায়, ঠিক প্রচলিত অর্থে টাকা নয়, তবে এক ধরনের বিকল্প টাকার ভাবনাই সেদিন ভেবেছিলেন নেতাজি।
আরও শুনুন – ‘লাঞ্ছনা’ সত্ত্বেও সুভাষকে ভোলেননি ইংরেজ অধ্যাপক ওটেন সাহেব, লিখেছিলেন কবিতাও
বিশ্বজুড়ে যে বা যাঁরা অনুদানে ইচ্ছুক, তাঁরাই অর্থ দিতে পারতেন। সেই টাকা খরচ করা হত আজাদ হিন্দ বাহিনির কাজে। অথবা কেউ যদি অন্য কোনও ভাবে সাহায্য করতে চাইতেন, তা-ও করতে পারতেন। এই ধরনের নোট অবশ্য বহুদিন অগোচরেই ছিল। ১৯৮০ সালে রামকিশোর দুবে এরকম একটি নোটের সন্ধান পান। তাঁর দাদুর সংগ্রহে থাকা রামায়ণ বইয়ের ভিতরে রাখা ছিল নোটটি। পরে জানা যায়, তাঁর পিতামহ গোপনে আজাদ হিন্দ বাহিনির হয়ে কাজ করতেন। নিজের বেশ কিছুটা জমি তিনি নেতাজির কাজের জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন। প্রতিদানে নেতাজির তরফ থেকে তাকে এই নোট দেওয়া হয়। সেটি ছিল লক্ষ টাকার নোট। যেখানে লেখা ছিল, স্বাধীনতা অর্জনের পর এই মূল্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি করা হচ্ছে। দেশকে যদি স্বাধীন করতেন নেতাজি তবে এই নোট আর কেবল স্মারক হয়ে থাকত না, এমন অনুমান করেন অনেকেই। তবে বলাই বাহুল্য যে এই নোটের ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। জানা যায়, জার্মানিতেই ছাপা হয়েছিল এই নোট। কাগজের একদিকেই ছাপা থাকত যাবতীয় তথ্য, অন্য পিঠে থাকত স্ট্যাম্প। এই ব্যাঙ্কের চালু করা নোটের পাশপাশি কিছু কয়েনও সংগ্রহ করা হয়েছে পরবর্তীকালে। কটকের মিউজিয়ামের গ্যালারিতে সযত্নে রক্ষিত আছে নেতাজির এই নিদর্শন। দেশকে স্বাধীন করতে নেতাজি যে কতটা বদ্ধপরিকর ছিলেন এবং কত সুদূরপ্রসারী ছিল তাঁর পরিকল্পনা – এই নোটগুলি আজও যেন তারই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।