সুভাষ ঘরে ফেরে নাই। তবু দেশনায়ক নেতাজি রয়ে গিয়েছেন দেশবাসীর মনের মণিকোঠায়। দেশের ইতিহাসে তাঁর অসম বীরত্বের কথা লেখা তো আছেই, কিন্তু দেশের জনমানসে যেভাবে জাগ্রত রয়েছেন নেতাজি, তা তুলনারহিত। তাঁর দেশের মানুষ যে তাঁকে মনে রাখবেন, তা অবশ্যম্ভাবী। তবে ভাবলে অবাকই হতে হয় যে, ইংরেজ অধ্যাপক ওটেন সাহেব, যাঁর সঙ্গে ঝামেলা হয়েছিল তরুণ সুভাষের, তিনিও তাঁকে মনে রেখেছিলেন দীর্ঘদিন। এমনকী তাঁর জন্য লিখেছিলেন কবিতাও। আসুন, সেই অনালোচিত ইতিহাস আজ স্মরণ করি।
প্রেসিডেন্সি কলেজের বিখ্যাত ইংরেজ অধ্যাপক ওটেন সাহেব। তাঁর সঙ্গে একবার দ্বন্দ্ব বেধেছিল সুভাষচন্দ্রের। ঘটনাটি ঐতিহাসিক। তবে এই ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে যা হয়, নানা মত দেখতে পাওয়া যায়, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যতদূর জানা যায়, ওটেন সাহেবের একটি বক্তব্যকে অপমানজনক মনে করেন ভারতীয় ছাত্ররা। এবং তার ফলেই পরবর্তীতে একরকমের সংঘর্ষের মুহূর্ত আসে। যেখানে লাঞ্চিত হতে হয় ওটেন সাহেবকে। অনেকে বলে থাকেন, সুভাষের হাতে এই লাঞ্চনার ঘটনা ঘটেনি। তবে ওটেন সাহেবের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ হয়েছিল, সে ঘটনার কথা স্বীকার করে গিয়েছিলেন স্বয়ং সুভষাচন্দ্র। তবে আশ্চর্য এই যে, এই ওটেন সাহেবও তাঁর পুরনো ছাত্রকে মনে রেখেছিলেন। এবং সুভাষ স্মরণে একটি কবিতাও লেখেন।
আরও শুনুন: দক্ষিণেশ্বর থেকে এল মায়ের আশীর্বাদ, ব্রিটিশ গোয়েন্দার চোখে ধুলো দিয়ে দেশ ছাড়লেন সুভাষ
এই কবিতার হদিশ আমাদের দেন ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিতরায়। তিনি জানাচ্ছেন, ওটেন সাহেবের এই কবিতাটি প্রথম সর্বসমক্ষে এনেছিলেন ডক্টর বিমানবিহারী মজুমদার। ১৩৭৬ বঙ্গাব্দের ‘কালি-কলম’ পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় তাঁর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। যার শিরোনাম ছিল ‘ওটেন ও সুভাষচন্দ্র’। সেখানেই তিনি এই কবিতাটির কথা উল্লেখ করেন। ওটেন সাহেবের ‘সং অফ অ্যাটন অ্যান্ড আদার ভার্সেস’ কাব্যগ্রন্থে লেখাটি সংকলিত হয়েছিল। বিমানবিহারী বাবু তাঁর আচার্য প্রমথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে এই বইটি পেয়েছিলেন, এবং সেখানেই এই কবিতার খোঁজ মেলে।
আরও শুনুন – জরুরি তলব চিত্তরঞ্জনের, এসেছে বিয়ের প্রস্তাব, মিলবে অনুদানও… কী জবাব সুভাষচন্দ্রের?
কবিতাটি যখন লেখা হয়েছিল, অর্থাৎ সেই ১৯৪৫ সালে সুভাষচন্দ্রের মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হয়েছে। তখনই প্রাক্তন ছাত্র স্মরণে এই লেখাটি তিনি লেখেন। অথচ যখন প্রেসিডেন্সিতে ঘটনাটি ঘটেছিল, তখন ইংরেজরা সুভাষের উপর যারপরনাই খাপ্পা ছিল। ওটেন সাহেবও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। কিন্তু একটা কথা স্বীকার্য যে, সেই সংঘর্ষ কোনও ব্যক্তিগত কারণে ছিল না। ছিল জাতির স্বার্থে। স্বজাতির মর্যাদার জন্য সেদিন যে এক শৌর্যবান যুবক রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, সম্ভবত এই বিষয়টি ওটেন সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল বেশ ভালোমতোই। আর তাই এই ছাত্রটির প্রতি তার নজর হয়তো থেকেই গিয়েছিল, নইলে মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হওয়ার মুহূর্তে তিনি সুভাষকে উদ্দেশ্য করে কিছু পঙক্তি রচনা করতেন না। সেদিনের সেই লাঞ্ছনার কথা মনে রেখেও, সেই লেখার ভিতর তিনি লিখেছিলেন, যে, “তোমার সম্মান ও মর্যাদাবোধ তোমাকে আইক্যারাসের মতো সমুদ্রের অভিমুখে চালিত করিয়াছি।” এই আইক্যারাস বা ইকেরাস হলেন গ্রিক পুরাণে বর্ণিত বীর। অর্থাৎ সুভাষের বীরত্ব যে ওটেন সাহবকে আলোড়িত করেছিল, তা স্পষ্ট।
বীর সুভাষের মহত্ব বুঝি এখানেই। তাঁর দেশের মানুষ, বিশ্ব রাজনীতির তাবড় মানুষ তাকে মনে রেখেছেন; তা স্বাভাবিকও। কিন্তু যে ইংরেজ অধ্যাপকের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব বেধেছিল, তিনিও যে তাঁর বীরত্ব স্মরণ করেছেন, তা সত্যিই আশ্চর্য করে। ইতিহাসের এই প্রায় অনালোচিত অধ্যায় তাই যেন আজ দীপ্ত হয়ে ওঠে অন্যরকম এক শ্রদ্ধার আলোয়।